Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

‘জন্মভূমি আজ’ কবিতার আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর :

নবম শ্রেণীর ‘সাহিত্য সঞ্চয়ন’ বইয়ের প্রতিটি বিষয় আমাদের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে । আজকের আলোচনা ‘জন্মভূমি আজ’ । ‘‘জন্মভূমি আজ ” ...

নবম শ্রেণীর ‘সাহিত্য সঞ্চয়ন’ বইয়ের প্রতিটি বিষয় আমাদের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে । আজকের আলোচনা ‘জন্মভূমি আজ’ ।

‘‘জন্মভূমি আজ ”
                              - বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

একবার মাটির দিকে তাকাও
একবার মানুষের দিকে।

এখনো রাত শেষ হয় নি;
অন্ধকার এখনো তোমার বুকের ওপর
কঠিণ পাথরের মত, তুমি নি:শ্বাস নিতে পারছ না।
মাথার ওপর একটা ভয়ঙ্কর কালো আকাশ
এখনো বাঘের মত থাবা উঁচিয়ে বসে আছে।
তুমি যেভাবে পারো এই পাথরটাকে সরিয়ে দাও
আর আকাশের ভয়ঙ্করকে শান্ত গলায় এই কথাটা জানিয়ে দাও
তুমি ভয় পাও নি।

মাটি তো আগুনের মত হবেই
যদি তুমি ফসল ফলাতে না জানো
যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও
তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি।
যে মানুষ গান গাইতে জানে না
যখন প্রলয় আসে, সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়।
তুমি মাটির দিকে তাকাও, সে প্রতীক্ষা করছে,
তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়।

    লেখক পরিচিতি :    
            বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯২০–১৯৮৫) : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর রচিত অজস্র কাব্যগ্রন্থে প্রকৃতি, চারপাশের মানুষজন, নানান জীবন সংগ্রাম ও পরিস্থিতি রূপায়িত হয়েছে। গ্রহচ্যুত, রাণুর জন্য, লখিন্দর, ভিসা অফিসের সামনে, মহাদেবের দুয়ার, মানুষের মুখ, ভিয়েতনাম ভারতবর্ষ, আমার যজ্ঞের ঘোড়া : জানুয়ারি ইত্যাদি তাঁর প্রধান কাব্যগ্রন্থ। তিনি বহু কাব্যগ্রন্থের অনুবাদ করেছেন।

     উৎস :   
       বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা “বেঁচে থাকার কবিতা” নামক কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে ‘জন্মভূমি আজ’ কবিতাটি।

    বিষয় অল্প কথায়:    
  • ‘জন্মভূমি আজ’ কবিতার বিষয়বস্তু হল স্বদেশপ্রেম এবং দেশের মানুষই মূল্যবান সম্পদ। 
  • কবি মাটিকে দেখেছেন মায়ের মতো। তিনি এই আশাই কবিতায় ব্যক্ত করেছেন যে মাটি আর মানুষে মিলে অন্তরঙ্গ জীবন মেলার মধ্য দিয়ে এ জীবন সার্থক হতে পারে। 
  • যতই দুঃখ, যন্ত্রণা, ব্যথা জীবনকে গ্রাস করুক না কেন তাকে যে-কোনো মূল্যে প্রতিহত করতেই হবে। যেখানে অন্যায়, অবিচার, শোষণ নির্যাতন, নিপীড়ন সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। 
  • তেমনি আবার মাটিকে কঠোর সাধনার মধ্যদিয়ে করে তুলতে হবে নরম করে। তবেই রাশি রাশি সোনার ফসলে ঘরে ভরে উঠবে। 
  • মাটিকে মা মনে করে তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মধ্যদিয়ে মাতৃভূমির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে। শুষ্ক মরুভূমিতে চাষ করে উর্বরা করে তুলতে পারলেই স্বদেশপ্রেমের প্রকৃত দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে।

    নামকরণের খুঁটিনাটি :    
  • কবির কাছে মাটি মায়ের মতো, তাই কবি মাটির দিকে ও মানুষের দিকে তাকাতে বলেছেন, তাঁর কাছে মানুষই মূল্যবান সম্পদ আর মাটি মাতৃ স্বরূপ। 
  • তিনি চেয়েছেন মাটি এবং মানুষের সুষ্ট সহাবস্থান। দুঃখ, দুর্দশা, যা কঠিন অন্ধকার হয়ে জগদ্দল পাথরের মতো বুকের ওপর চেপে বসে আছে। হাজার প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে এই বুকচাপা পাথরকে দূরে সরিয়ে ঠেলে দিতেই হবে। 
  • বন্ধ্যা মাটিকে কঠোর কৃচ্ছ সাধনের মধ্যে দিয়ে করে তুলতে হবে সরস ও কোমল । ফলাতে হবে রাশি রাশি সোনালী ফসল। মাটি আর মানুষ যদি একাত্ম হয় তখনই তা হবে স্বদেশ প্রেমের প্ৰকৃত দৃষ্টান্ত ।

    রসবিচার :   
          ‘জন্মভূমি আজ’ কবিতাটি স্বদেশপ্রীতিমূলক কবিতা। এখানে মাটি আর মানুষকে একসঙ্গে একসূত্রে আবদ্ধ হবার কথা স্বীকার করা হয়েছে। মানুষের প্রতি তাঁর প্রীতি ও ভালোবাসার কথা শুনিয়েছেন কবি। বর্ণিত আর ব্যথিত মানুষের কল্যাণে তিনি আত্মনিয়োগ করেছেন। যে-কোনো অন্যায়ের প্রতি প্রতিবাদী হওয়ার শপথ নিয়েছেন কবি। স্বদেশপ্রেমের জয়গানে এই কবিতা বীররসের মাত্রা পেয়েছে ঠিকই কিন্তু মাটি আর সরল মানুষের প্রসঙ্গে অন্যদিকে শান্ত রসেরও মিলন ঘটেছে।

     নির্বাচিত প্রশ্নোত্তর :    
১) ‘জন্মভূমি আজ’ কবিতার কবি কে ? মূল কাব্যগ্রন্থের নাম কি ? কবিতার বিষয়বস্তু সংক্ষেপে লিখুন । 
 ‘জন্মভূমি আজ’ কবিতার কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । 
 মূল কাব্যগ্রন্থের নাম ‘বেঁচে থাকার কবিতা’ । 
 কবিতার বিষয়বস্তু :
    স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ কবি মানুষকেই মূল্যবান সম্পদ হিসেবে দেখেছেন। মাটিকে দেখেছেন মাতৃরূপে। তিনি চেয়েছেন মাটি আর মানুষের সুষ্ঠু সহাবস্থান। দুঃখ ও দুর্যোগের কঠিন অন্ধকার ঠেলে বন্ধ্যা মাটিকে কঠোর কৃচ্ছসাধনের মধ্য দিয়ে করে তুলতে হবে সরস ফলাতে হবে রাশি রাশি সোনালি ফসল। মাটির গন্ধে ভরপুর হয়ে মাটিকে করতে হবে মা। মাটি আর মানুষ যদি একাত্ম হয় তবেই তা হবে স্বদেশপ্রেমের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত । 

২. জন্মভূমি আজ কবিতাটির রসবিচার করো।
রসবিচার :
        'জন্মভূমি আজ' 'স্বদেশানুরাগের কবিতা। মানুষের প্রতি একান্ত ভালোবাসা থেকেই বঞ্ছিত ও ব্যথিত মানুষের জন্য ব্যাকুলতা উপলব্ধি করেছেন এ কবিতার কবি। অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নির্যাতন সহজভাবে তুলে ধরে, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সরব হওয়ার কথা প্রতীকায়িত হয়ে এবং স্বদেশপ্রেম ঐকান্তিক হয়ে বীররসের জন্ম হয়েছে কবিতায় আবার মাটি-মানুষের সংযুক্তিতে শান্ত স্নিগ্ধ এক বাতাবরণও সৃষ্টি হয়েছে।

৩. ‘একবার মাটির দিকে তাকাও / একবার মানুষের দিকে’ --  অংশটি কোন কবিতার ? মাটি কীসের প্রতীক? মাটি ও মানুষ দিয়ে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন ?
 অংশটি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিরচিত ‘জন্মভূমি আজ’ কবিতা থেকে সংগৃহীত। 
 এ কবিতায় মাটি মায়ের প্রতীক, স্বদেশের প্রতীক।
 মাটি ও মানুষ এ কবিতার মূল রসদ। পরিশ্রমী মানুষ আর মাটির মেলবন্ধন স্বদেশের অগ্রগতির সোপান। দেশ-কাল ও স্বদেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা মাটি আর মানুষকে একাক্কা করে দেয়। মানুষই পারে মাটি কর্ষণ করে দেশের সম্পদের ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে।

৪. ‘তুমি যে ভাবে পারো এই পাথরটাকে সরিয়ে দাও’ - তুমি বলতে' কাকে বোঝানে হয়েছে ? কোন পাথর কীভাবে সরাতে হবে এবং কেন?
 ‘তুমি’ বলতে আপামর নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত মানুষের কথা বলা হয়েছে। 
 দুঃখ-দুর্যোগ-হতাশাক্লিষ্ট মানুষেরাই সমাজের সিংহভাগ অধিকার করে আছে। এই সব প্রতিকূলতা, সমস্যা অবরোধ সৃষ্টি করে রেখেছে অগ্রগতির পথে। দেশের কল্যাণসাধনে উন্নতির সোপান গড়তে প্রয়োজন এই জগদ্দল পাথরের অপসারণ। মাটি আর মানুষের সুষ্ঠু মেলবন্ধনই কেবলমাত্র উত্তরণ ঘটাতে পারে দেশ-মাটি মায়ের। অন্ধকার দূরে সরিয়ে মা মাটিকে আপন করে নিতে পারলেই উত্তরণ ঘটবে দেশ ও জাতির।

৫. যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও / তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি।’ -- ‘বৃষ্টি আনার মন্ত্র’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? কীভাবে স্বদেশ মরুভূমিতে পরিণত হয় ?
 ‘বৃষ্টি আনার মন্ত্র’ অর্থে কবি বুঝিয়েছেন মাটিকে খাঁটি করে উর্বর করে গড়ে তোলার কৌশল -- যা সম্ভবত মাটির সঙ্গে হার্দিক সম্পর্ক গড়ে তোলে।
 সমস্যাদীর্ণ বৃহত্তর মানুষের বাঁচার একমাত্র মন্ত্র শক্ত হাতে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। স্বদেশের প্রতি প্রবল অনুরাগ মাটির বুকে যদি ফসলের ডালি সাজিয়ে তুলতে না পারে তাহলে -কর্ষণহীন মাটি মরূভূমিতে পরিণত হবে। পাহাড়ের মতো চেপে থাকা দুঃখ-দুর্যোগের বিরুদ্ধে সরব হতে না পারলে আপামর জনগোষ্ঠী হয়ে উঠবে মরূভূমির মতো বিশুদ্ধ, অনুর্বর।

৬. ‘যখন প্রলয় আসে, সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়।’ -- এই অংশে কার কথা বলা হয়েছে ? ‘বোবা’ ও ‘অন্ধ’ হয়ে যায় কেন?
 এই অংশে জন্মভূমির কথা বলা হয়েছ।
 জন্মভূমি মানুষের মাতৃসম। আবার জন্মভূমির মাটিতে ফসল ফলিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। কিন্তু যখন বন্যা, খরা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সে মাটি অজন্মা হয়ে যায়, মানুষকে ক্ষুধার আহার দিতে ব্যর্থ হয় সে হয়ে ওঠে বোবা ও অন্ধের মতো । বৃষ্টি আনার মন্ত্র না জানলে যেমন স্বদেশ মরূভূমি হয়ে যায়, প্রলয়ের কালেও তার কোনো অস্তিত্বই থাকে না।

৭. ‘তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়।’ -- উক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
তাৎপর্য :
        ‘জন্মভূমি আজ’ কবিতায় মানুষ এবং মাটিকে একাত্ম করে দেখেছেন কবি। মাটি যেন মানুষের জন্যেই প্রতীক্ষা করে থাকে, মা যেমন থাকে তার সন্তানের প্রতীক্ষায়। মানুষ যদি মানুষের হাত ধরে এগিয়ে যেতে চায় তবেই সে চলা সার্থক হয়ে ওঠে। মাটির সঙ্গে মিশে আছে মানুষের সত্তা। মাটি আর মানুষ তাই হয়ে গেছে একাকার।

৮. “এখনও রাত শেষ হয়নি / অন্ধকার এখনো তোমার বুকের ওপর। /কঠিন পাথরের মতো তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারছ না।” -- তাৎপর্য লেখ।
 তাৎপর্য :
         উদ্ধৃত অংশটিতে অন্ধকার বিশেষ একটি অর্থ নিয়ে দ্যোতিত হয়েছে। কবি অন্ধকার বলতে দুঃখ-দুর্যোগের কথাকে বলেছেন যা সমাজের বুকে পাথরের মত চেপে বসে আছে। এ পাথর না সরালে দুর্ভাগ্যের কালো আকাশ থেকে সূর্যের মুখ কোনো দিনই দেখা যাবে না। পরাধীন দেশের অন্ধকার কখনও মিলিয়ে যায় নি । জন্মভূমির বুকের ওপর কঠিন পাথরের মতো চেপে বসে আছে । যাকে দূর না করলে নিস্তার নেই। এ শুধু জন্মভূমির নয়, দেশের অগণিত সাধারণ আর্ত মানুষের বুকের ওপরেও জমাট বেঁধে রয়েছে। যারা সেই কঠিন পাথরের মতো কালো দুর্ভাগ্যের ভারে পৃষ্ট ও প্রবল চাপে স্বস্তির নিঃশ্বাসটুকুও ফেলতে পারছে না। মানুষের দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের এক চিলতে অংশ উদ্ধৃত অংশেকবি তুলে ধরেছেন । 

৯. “তুমি মাটির দিকে তাকাও, সে প্রতীক্ষা করছে / তুমি মানুষের হাত ধর সে কিছু বলতে চায়।” --- আলোচ্য অংশের উৎস নির্দেশ কর। আলোচ্য অংশে কবির কিরূপ মানসিকতা প্রকাশিত হয়েছে ?
 আলোচ্য অংশটি কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা 'বেঁচে থাকার কবিতা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত জন্মভূমি আজ’ কবিতা থেকে গৃহীত।
 মাটি এবং মানুষের কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় মাটি এবং মানুষকে অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন।  যারা এই সমাজের অগ্রভাগ তারাই সমাজের কাছে অবহেলিত, শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত। মানুষ যদি মানুষের দুর্বলতার সুযোগকে গ্রহণ না করে তার পাশে এসে দাঁড়ায় তবেই সমাজের উন্নতি হবে। মা. মাটির এই বন্ধ্যাত্বকে ঘুচিয়ে দিতে পারে কিন্তু মানুষই । মানুষই পারে বোবার মুখে বসিয়ে দিতে ভাষা। অন্ধের চোখে জ্বেলে দিতে আলো। আর তবেই সভ্যতার উন্নতি ও সমৃদ্ধি হবে। কবি সেকারণেই মাটির দিকে তাকাতে বলেছেন, কেননা মাটি প্রতীক্ষা করছে তার ফল প্রত্যাশায়। আর সেকারণে মানুষের হাত ধরে মানুষের প্রতি ভালোবাসায়, মানুষের সাহায্যে দুর্যোগের হাত থেকে উত্তরণের কথা বলেছেন কবি।

3 comments