Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

‘একাকারে’ কবিতার আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর :

    দশম শ্রেণীর ‘সাহিত্য সঞ্চয়ন’ বইয়ের প্রতিটি বিষয় আমাদের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে । আজকের আলোচনা ‘একাকারে’ । ‘‘একাকারে”       ...

  দশম শ্রেণীর ‘সাহিত্য সঞ্চয়ন’ বইয়ের প্রতিটি বিষয় আমাদের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে । আজকের আলোচনা ‘একাকারে’ ।

‘‘একাকারে”
                             - সুভাষ মুখোপাধ্যায়

এসো, এই ঝরনার সামনে—
নতজানু হয়ে
আমাদের দুহাত-এক-করা
অঞ্জলিতে
তোমার পানি আর আমার জল
জীবনের জন্যে
একসঙ্গে একাকারে ভ’রে নিই।

দেখো, জপমালা হাতে
তোমার মা আর আমার আম্মা
জগৎজোড়া সুখ
আর দুনিয়া জুড়ে শাস্তির জন্যে
একাসনে
একাকারে প্রার্থনা করছেন।

শোনো
কোরানের সুরাহ্র সঙ্গে
উপনিষদের মন্ত্র,
সকালে প্রভাতফেরির সঙ্গে
ভোরের আজান
একাকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।।

    লেখক পরিচিতি :    

            সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯–২০০৩) : বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য নাম। নদীয়া জেলার কৃস্তনগরে জন্ম। স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শনের ছাত্র ছিলেন। ১৯৪০ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ‘পদাতিক’ প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে ‘অগ্নিকোণ’, ‘চিরকুট’, ‘ফুল ফুটুক’, ‘খত দুরেই যাই’, ‘কাল মধুমাস’, ‘ছেলে গেছে বনে', 'জল সইতে’, ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’, ‘ধর্মের কল’, ‘বাঘ ডেকেছিল' প্রভৃতি। তাঁর গদ্য রচনার দৃষ্টাস্ত ‘কাঁচা-পাকা’, ‘ঢোল গোবিন্দের আত্মদর্শন’, ‘ঢোল গোবিন্দের মনে ছিল এই’, ‘আমার বাংলা’, ‘নারদের ডায়রি’, ‘কমরেড কথা কও','ফকিরের 'আলখাল্লা' প্রভৃতি গ্রন্থে ছড়িয়ে রয়েছে। তিনি অনুবাদ করেছেন নাজিম হিকমত, পাবলো নেরুদার কবিতা। বহু পুরস্কারে ভূষিত এই কবি ‘সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু পুরস্কার’, ‘সাহিত্য অকাদেমি’ ও ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কারও পেয়েছেন।


     উৎস :   
               সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'বাঘ ডেকেছিল’ কাব্যগ্রন্থের ১৯ সংখ্যক কবিতা ।

    বিষয় অল্প কথায়:    
  • পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান সমস্যার দিনে একার প্রার্থনায় বুঝি কিছুই হবে না। এজন্য নতজানু হয়ে বা দুহাতের অঞ্জলিতে প্রার্থনা করা। 
  • হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। একজনের পানি আর একজনের জলই জীবনের কুম্ভ পূর্ণ করে দিতে পারে। 
  • জপমালা হাতে আমার মা আর আম্মারা জগৎজোড়া খুনের সন্ধানে, দুনিয়া জোড়া শান্তির খোঁজে একাসনে বসে একাকারে প্রার্থনা করে। 
  • কোরান ও উপনিষদের মন্ত্র সকালে প্রভাতফেরীর সাথে ভোরের আজান একাকারে মিলে যাচ্ছে।

    নামকরণের খুঁটিনাটি :    
  • কবির মনে হয়েছে পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান সমস্যার দিনে একার প্রার্থনায় কিছুই হবে না, এরজন্য নতজানু হয়ে  দুহাতের অঞ্জলিতে প্রার্থনা করা প্রয়োজন। 
  • হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। একজনের পানি আর একজনের জলই জীবনের কুম্ভ পূর্ণ করে দিতে পারে। এদিক থেকে দুই জাতি মিলে মিশে একাকার হয়ে যাবে ।
  • জপমালা হাতে আমার মা আর আম্মারা জগৎজোড়া খুনের সন্ধানে, দুনিয়া জোড়া শান্তির খোঁজে একাসনে বসে একাকারে প্রার্থনা করে। কোরান ও উপনিষদের মন্ত্র সকালে প্রভাতফেরীর সাথে ভোরের আজান একাকারে মিলে যাচ্ছে। এখানে নামকরণ ব্যঞ্জনাময় হয়েছে ।

    রসবিচার :   
         কবির মনে হয়েছে পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান সমস্যার দিনে একার প্রার্থনায় কিছুই হবে না, এরজন্য হিন্দু ও মুসলিম উভয়কে নতজানু হয়ে  দুহাতের অঞ্জলিতে প্রার্থনা করা প্রয়োজন।  একজনের পানি আর একজনের জলই জীবনের কুম্ভ পূর্ণ করে দিতে পারে। এদিক থেকে দুই জাতি মিলে মিশে একাকার হয়ে যাবে । জপমালা হাতে আমার মা আর আম্মারা জগৎজোড়া খুনের সন্ধানে, দুনিয়া জোড়া শান্তির খোঁজে একাসনে বসে একাকারে প্রার্থনা করে। কোরান ও উপনিষদের মন্ত্র সকালে প্রভাতফেরীর সাথে ভোরের আজান একাকারে মিলে যাচ্ছে। ফলে কবিতাংশটিতে স্নেহ বাৎসল্যের পাশাপশি বীররসেরও প্রাধান্য রয়েছে ।

     নির্বাচিত প্রশ্নোত্তর :    

১.'একাকার এ' কবিতার কবি কে ? মূল কাব্যগ্রন্থের নাম কি?কবি কোন কোন রচনার জন্য জ্ঞানপীঠ ও সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন ?
 ‘একাকারে’ এর কবি হলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় ।
 মূল কাব্যগ্রন্থের নাম হল 'বাঘ ডেকেছিল’ গ্রন্থের ১৯ সংখ্যক কবিতা ।
 সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জ্ঞানপীঠ পুরস্কার প্রাপ্ত রচনা হলো ‘পদাতিক’ ও সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত রচনা হলো ‘যত দূরে যায়’।

২ . এসো , এই ঝর্নার সামনে -- নতজানু হয়ে ---- উৎস নির্ণয় করুন? ঝরনার সামনে আসতে বলেছেন কেন? নতজানু শব্দটি কেন ব্যবহার করলেন?
 উক্ত চরণটি পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বাঘ ডেকেছিল’ কাব্যগ্রন্থের ১৯ সংখ্যক কবিতা একাকারে থেকে নেওয়া হয়েছে ।
 উক্ত কবিতাটিতে কবি মানব-মানবীকে প্রকৃতির অকৃত্রিম ভালোবাসার কাছে আসতে বললেন ।
 ‘নতজানু’ শব্দের দ্বারা বোঝাতে চাইলেন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের শিক্ষা নতজানু অর্থাৎ হাঁটু ভাঁজ করে নত মস্তিস্কে গ্রহণ করে নিতে হয়।

৩ . আমাদের দুই হাত এক করা অঞ্জলিতে আমাদের বলতে কবি কি বোঝাতে চেয়েছেন? দুহাত এক করা আসলে কি ? অঞ্জলি কেন দেবে ?
 সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘একাকারে’ কবিতার মধ্য দিয়ে আমাদের বলতে কবি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ কে বুঝিয়েছেন ।
 এখানে দুহাত বলতে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মিলিত হাতকে বোঝাতে চেয়েছেন । 
 মঙ্গলময় এর কাছে সমগ্র মানবজাতির কাম ,ক্রোধ ,লোভ ,মোহ প্রভৃতি বিসর্জন দিয়ে শান্তিতে একত্রে থাকার জন্য অঞ্জলি দেবে ।

৪ ‘তোমার পানি আর আমার জল / জীবনের জন্য’ --তোমার পানি বলতে কবি কি বলতে চেয়েছেন? আমার জল আসলে কি ? কি জিনিস জীবনের জন্য?
 কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একাকারে কবিতায় তোমার পানি বলতে কবি মুসলমান সম্প্রদায়ের পানি হল হিন্দি শব্দ জলের সমার্থক শব্দ। 
  আমার জল হলো হিন্দু সম্প্রদায়ের পানির সমার্থক শব্দ জল অর্থাৎ পানি আর জলের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই।
 পানি ও জল উভয় সম্প্রদায়ের কাছে জীবনের জন্য খুবই জরুরী যা ঈশ্বর প্রদত্ত আমরা লাভ করে থাকি।

৫ ‘একসঙ্গে একাকারে ভরে নিই’ - চরণটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো?
তাৎপর্য :
        উক্ত চরনটি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একাকারে কবিতার অংশবিশেষ।উক্ত চরণটিতে কবি বোঝাতে চেয়েছেন হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে অন্তর্গত কোন প্রভেদ নেই । একই জিনিস কে বিভিন্ন নামে ডাকি কেবল যার ব্যবহার উভয় সম্প্রদায়ের কাছে একই সেক্ষেত্রে পানি ও জল যা একই অর্থে উভয় সম্প্রদায়ের ব্যবহার করে থাকে।


৬ ‘জপমালা হাতে /তোমার মা আমার আম্মা’ ---- জপমালা কি ? কবি কবিতায় ‘মা’ ও ‘আম্মা’ শব্দ দুটি কেন ব্যবহার করেছেন?
 কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘একাকারে’ কবিতায় ‘জপমালা’ বলতে বুঝিয়েছেন- যে মালা অবলম্বন করে কতবার জপ হচ্ছে তার সংখ্যা রাখা। এই জপমালা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের ঈশ্বর নাম বা আল্লাহর নাম জপ করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করে।
 হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে ‘মা’ আর মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে ‘আম্মা’ শব্দগত দিক আলাদা হলেও অর্থগত দিক একই মা তো মা একই হন তার সম্প্রদায় ভেদে কোন পার্থক্য থাকে না ।

৭ ‘দুনিয়া জুড়ে শান্তির জন্য একাসনে’-- এখানে ‘দুনিয়া জুড়ে’ বলতে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন ? একাসনে বসে কি করে?
 কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার ‘একাকারে’ কবিতার মধ্যে বলতে চেয়েছেন হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে ধর্মের আফিম খাইয়ে সহজে বিভেদের রাজনীতি করা যায় । কিন্তু উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মের অভ্যন্তরীণ অর্থ একই আছে ।
 যারা ধর্মের এই অর্থ জানতে পেরেছেন তারা পুরো পৃথিবীর মানবের মঙ্গলকামনায় একাসনে বসে প্রার্থনা করে সেই প্রার্থনায় কোন হিন্দু মুসলমানের ভেদাভেদ থাকে না ।

৮ ‘কোরআনের সূরাহর সঙ্গে উপনিষদের মন্ত্র’ বলতে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন?
 কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার ‘একাকারে; কবিতার মধ্যে মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থ কোরআনের সুরাহর সঙ্গে হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ উপনিষদের মন্ত্রের মূল অর্থ যে এক তা বোঝাতে চেয়েছেন। এই দুই গ্রন্থের মধ্যে অর্থগত কোন বিভেদ নেই কিন্তু এই দুই গ্রন্থের অনুসারী ব্যক্তিরা গ্রন্থের প্রকৃত অর্থ না বুঝে উভয়ের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে।যা প্রকৃত ধর্ম জ্ঞানের পরিপন্থী নয় ।

৯. ‘সকালের প্রভাতফেরির সঙ্গে/ ভোরের আজান’----- প্রভাতফেরির সঙ্গে ভোরের আজান এর মিল কোথায়?
 কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার ‘একাকারে’ কবিতায় দেখিয়েছেন একদা শ্রীচৈতন্যদেব তার ভক্তদের নিয়ে সকালবেলায় নগর সংকীর্তন করতেন সমগ্র মানবের মঙ্গল কামনায় । ঠিক তেমনি ভোরের আজান -এর আহ্বানের ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ও সকলে একত্রে মিলিত হয়ে সকালে আল্লাহর কাছে সমগ্র মানবজাতির শান্তি কল্যাণ কামনা করে। অন্তর্নিহিত অর্থ যে এক তা বর্ণনা প্রসঙ্গে উক্ত শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

১০. ‘একাকারে মিলিয়ে যাচ্ছে’--- কি মিলিয়ে যাচ্ছে বলে কবি অনুভব করেছেন?
 কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লক্ষ্য করেছেন ভারতবর্ষের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কিভাবে ধর্মের নামে বিভেদ, হানাহানি হচ্ছে । তাই তার একাকারে কবিতায় বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান যে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ তা তুলে ধরলেন । উভয় সম্প্রদায়ের জল - পানি, মা -আম্মা, কোরআন- উপনিষদ , প্রভাতফেরী -ভোরের আজান যে এক এবং একাকারে মিলে যায় তা নিজে অনুভব করলেন ও পাঠকের কাছে তুলে ধরলেন।

No comments