Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর :

  দশম শ্রেণীর ‘সাহিত্য সম্ভার’ বইয়ের প্রতিটি বিষয় আমাদের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে । আজকের আলোচনা ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ । ‘‘কান্ডার...

 দশম শ্রেণীর ‘সাহিত্য সম্ভার’ বইয়ের প্রতিটি বিষয় আমাদের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে । আজকের আলোচনা ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ ।


‘‘কান্ডারী হুঁশিয়ার”
                             - কাজী নজরুল ইসলাম

দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!

দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।

তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।।

অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার

গিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ!
কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!

কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।

ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান
আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!


    লেখক পরিচিতি :    

           কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬): বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৩২৬ বঙ্গাব্দে 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য' নামক পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা মুক্তি প্রকাশিত হয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ‘বিজলী’ পত্রিকায় বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কবি তাঁর কবিতায় কেবল ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নয়, সমস্ত অন্যায় অবিচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর রচিত বইগুলো হলো – অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, সাম্যবাদী, সর্বহারা, ফণীমনসা, প্রলয়শিখ৷৷


     উৎস :   
              কাজী নজরুল ইসলামের ‘সর্বহারা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে ।

     পটভূমি :   
              ১৯২৬ খ্রীঃ কবিতাটি বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে উদ্বোধনী সংগীত রূপে গীত হয়েছিল। একদিকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের → মৃত্যু অপরদিকে সুভাষচন্দ্রের মান্দালয়ে হাজতবাস । এমন অবস্থায় বাকী নেতারা নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য পরস্পরের সঙ্গে লড়াইয়ে বিধ্বস্ত । ১৯২৬ খ্ৰীঃ প্রথম দিকে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। এই সব কথাকে স্মরণ রেখে দেশের এক সংকটময় পরিস্থিতিতে কবি এই কবিতাটি রচনা করেন।

    বিষয় অল্প কথায়:    
  • দেশের সংকটময় মুহূর্তে দেশনেতাকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হয়। ঝঞ্ঝা ক্ষুব্ধ নদীর বুকে সমস্ত যাত্রীকে কাণ্ডারী যেমন অতিসাবধানে পার করে দেন। ঠিক তেমনি দেশনায়কও দেশের কঠিন মুহূর্তে সেই হাল ধরেন। 
  • এখানে কাণ্ডারী হলেন দেশনায়ক । 
  • সাম্প্রদায়িক বিভেদ ভুলে দেশনেতাকেই দেশবাসীর মনের মধ্যে ঐক্যবোধকে জাগিয়ে তুলতে হবে। জাত নয় জাতীর মুক্তিই প্রয়োজন। আর এর জন্য প্রয়াসী হতে হবে দেশনেতাকেই। 
  • কবি দেশনেতাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন জাতীয় জীবনাকাশে স্বাধীন সূর্য বিরাজমানতার জন্য দেশনেতার প্রয়াস গ্রহণ একান্ত কাম্য।
    নামকরণের খুঁটিনাটি :    
  • ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার' কবিতাটিতে কবি কাণ্ডারি বলতে দেশপ্রেমিক নেতা, স্বাধীনতা আন্দোলনের বুঝিয়েছেন।
  • স্বাধীনতা সংগ্রামকে একটা নৌকা যাত্রার সঙ্গে তুলনা করে, তার প্রতিকূলতাগুলিকে প্রাকৃতিক দুর্গমতার সঙ্গে মিলিয়ে গানটি রচিত। এই পরিস্থিতিতে দেশ নেতাকে হুঁশিয়ার করাই কবির লক্ষ্য। 
  • কবিতাতে ‘কাণ্ডারি হুঁশিয়ার' কথাটিকে বার বার ধ্রুবপদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ওই কথাটিই কবির অভিপ্রায়।

    রসবিচার :   
         ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার' কবিতাটি মূলত স্বদেশপ্রীতিমূলক কবিতা। স্বাধীনতা আন্দোলনের এক ক্রান্তি মুহূর্তে দেশ নেতাকে কবি পথের দায়িত্ব ও বিপদ সম্পর্কে সাবধান বানী শুনিয়েছেন। কাণ্ডারী যেন সেই দায়িত্ব গ্রহণ করে যার দ্বারা সে এই অচলাবস্থার উত্তরণ ঘটাতে পারে। দেশের মুক্তি সংগ্রামীদের প্রেরণা দিয়েছেন যাতে তারা দুঃখের অমারাত্রি পার হতে পারে। এ কবিতার সামগ্রীক ভাব অনুপ্রেরণামূলক ।


     নির্বাচিত প্রশ্নোত্তর :    

১.“দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার,”–কার, কোন কবিতার অংশ ? ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন ?
 সাম্যবাদের জয় ঘোষণাকারী কবি নজরুল ইসলামের “সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার অংশ।
দুগর্ম গিরি কান্তার মরু :
        স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিকূল অবস্থা বোঝাতে কবি পথের কতগুলি দুর্গমতার চিত্র এঁকেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিকদের অতি সংগোপনে প্রায় নিরস্ত্র ও সহায়হীন অবস্থায় প্রবল শক্তিমান সশস্ত্র শাসকবর্গের বিরুদ্ধে লড়তে হয়। পথের প্রতিবন্ধকতা বা দুর্গমতাগুলি স্বাধীনতা সংগ্রামীর সংগ্রামের কঠোরতার প্রতীক।

২. “লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার”–কোন্ কবিতার অংশ এটি ? কবি যাত্রীদের হুঁশিয়ার করেছেন কেন?
  বিদ্রোহী কবি নজরুলের 'সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত 'কাণ্ডারী হুঁশিয়ার' কবিতার অংশ এটি।
হুঁশিয়ার করার কারণ :
         পরাধীন ভারতবাসীর জীবনে স্বাধীনতার আলো আনতে উৎসর্গীকৃত দেশ নেতাদের কবি সতর্ক ও সচেতন করতে চেয়েছেন। দুর্গম দুস্তর পারাবার দিয়ে রাত্রি নিশিথে পার হতে হবে অর্থাৎ সমস্ত প্রতিবন্ধকতা থাকবে কিন্তু তাকে উপেক্ষা করে এগোতে হবে। কবি এই সাবধান বাণী শুনিয়েছেন।

৩. “লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার”–কার, কোন কবিতার অংশ ? 'রাত্রি' এবং 'নিশিথে' শব্দদুটি কী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ?
  সাম্যবাদের জয় ঘোষণাকারী কবি নজরুল ইসলামের ‘সর্বহারা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কান্ডারী হুঁশিয়ার' কবিতার অংশ।
  ‘রাত্রি’ ও ‘নিশিথে’ প্রায় সমার্থক শব্দ দুটি শব্দেরই অগ রাত্রিকাল বা নিশাকাল । তবে রাত্রিকাল বলতে নিশাকালের যেকোন সময়কালকে বোঝায় । কিন্তু নিশিপ বলতে কেবল গভীর অন্ধকার রাত্রিকেই বোঝায় । কবি এখানে পরাধীনতাকে জমাট অন্ধকারের সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং বলতে চেয়েছেন এই জমাট অঙ্গকারকে লঙ্ঘন করেই স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে।

৪. “দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ ছেজল, ছিঁডিয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত ? উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য লেখ।
 সাম্যবাদের জয় ঘোষণাকারী কবি নজরুল ইসলামের “সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার অংশ। 
তাৎপর্য :
        পরাধীনতার অন্ধকার রাতে স্বাধীনতা সংগ্রামীৱা বাড়ের অন্ধকারে মুক্তির জন্য এগিয়ে গেছে। বাঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্র প্রতিকূল পরিবেশের দ্যোতক। তরী দুলছে কারণ সমুদ্র অশান্ত। সমুদ্রের জল ফুটে উঠেছে কারণ চারিদিকে প্রতিরোধ ও প্রতিকূলতা। কবি জানতে চান এই তাবস্থায় কার কত শক্তি যে দেশের হাল ধরবে।

৫. “ছিড়িয়াছে পাল কে ধরিবে হাল আছে কার হিম্মত" তাৎপর্য লেখ।
 সাম্যবাদের জয় ঘোষণাকারী কবি নজরুল ইসলামের “সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার অংশ। 
 তাৎপর্য :
        কাণ্ডারী হুঁশিয়ার কবিতাটি রচনাকালে ভারতবর্ষে ঘটে গেছে এক তীব্র সংকট। একদিকে হিন্দুমুসমিলের দাঙ্গা। অপরদিকে দেশবন্ধুর মৃত্যু ও সুভাষচন্দ্রের কারাগারে বন্দী জাতীয় আন্দোলনের গতিকে ডানেকটাই শ্লথ করে দিয়েছিল। চলছে দলে দলে নেতৃত্ব দখলের প্রতিযোগিতা। এরকম অবস্থায় যোগ্য দেশনেতা নির্বাচন করতে চেয়েছেন কবি । যে যাত্রী বোঝাই তরীকে স্বাধীনতার পারে পৌঁছে দিতে পারবে । 
         সমুদ্রে যাত্রাপথে নৌকোর পাল যদি ছিড়ে যায় তবে অগ্রগতি ব্যহত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য দেশব্রতী সৈনিকদের মনে চরম দ্বিধা ও সংকট অতএব স্বাধীনতার দায়িত্বভার গ্রহণ করবে কে?

৬. “তিমির রাত্রি, মাতৃ মন্ত্রী সান্ত্রিরা সাবধান।”—তাৎপর্য লেখ।
 সাম্যবাদের জয় ঘোষণাকারী কবি নজরুল ইসলামের “সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার অংশ। 
 তাৎপর্য :
       ‘সান্ত্রি' শব্দটি এসেছে ইংরেজি শব্দ 'Sentry' থেকে। এর অর্থ সৈনিক বা রক্ষী বা প্রহরী । চারিদিকে ঘনঘোর রাত্রি পরাধীনতার অন্ধকার রাতে মাতৃ মন্ত্র নিয়ে দেশব্রতীরা এগিয়ে চলেছে। কবি সতর্ক প্রহরীকে বলছেন সতর্ক হতে। স্বাধীনতা সংগ্রামের মন্ত্র যা মাতৃ মন্ত্র – বন্দে মাতরম্। মাতৃ নাম স্মরণ করে দেশমাতৃকার চরণে আত্মনিবেদনই দেশব্রতীদের কর্তব্য। তাই এরা স্বাধীনতার সৈনিক ও প্রহরী।

৭. “ফেনাইয়া ওঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান।/ ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার ।।' প্রশ্ন কবিতাংশটি কার কোন কবিতার অংশ ? তাৎপর্য লেখ।
 সাম্যবাদের জয় ঘোষণাকারী কবি নজরুল ইসলামের “সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার অংশ। 
 তাৎপর্য :
     স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে কোন সম্প্রদায়ভেদ নেই। উদ্ধৃত অংশে ইহাদের বলতে কবি হিন্দুর পাশাপাশি মুসলমানদের কথা বলতে চেয়েছেন । স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু মুসলিম উভয়ের ঐক্যের মধ্য দিয়েই অগ্রসর হওয়া শ্ৰেয় একথা কবি বলতে চেয়েছেন। হিন্দু মুসলিমের দীর্ঘকালের পুঞ্জীভূত অভিমান যাকে অপসারিত করে কবি সংগ্রামমুখীনতার পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলতে চেয়েছেন। কবি বলেছেন হিন্দু নয় মুসলিম নয়, স্বাধীনতার অস্তগামী সূর্যকে আবার পূব আকাশে ফিরিয়ে আনতে গেলে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদকে ভুলে যেতে হবে। হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ কখনই স্বাধীনতা আনতে পারে না। বরং পরস্পরের মধ্যে এই বিভেদ দাঙ্গাময় এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তাই কবি হিন্দু মুসলিমদের একই পথের পথিক হতে বলেছেন এবং পিছিয়ে থাকা মুসলিমকে বঞ্চিত করে নয়, তাকে তার অধিকার প্রদান করে এগিয়ে চলার মন্ত্রে উজ্জীবিত করলেই স্বাধীনতা আসবে।

৮. "অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ।” এই জাতি অসহায় কেন ? তারা ডুবে মরছে কেন ?
অসহায়তার কারণ :
        নজরুল মখন এ কবিতা লিখছেন তখন দেড়শতাধিক বৎসর ইংরেজদের শাসনের অধীনে চরম সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে এস্ত সমগ্র ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষের সমস্তরকম অগ্রগতির পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে অত্যাচারী ইংরেজরা। সেকারণেই জাতীর অগ্রগতির পথে শৈবাল দামের মিছিল দেখে কবি এই জাতীকে অসহায় জাতী বলেছেন।
ডুবে মরার কারণ :
        এই অসহায় জাতী পরাধীনতার অতল সলিলে ডুবে মরছে। আত্মমুক্তির সুযোগ অবরুদ্ধ হওয়ায় কবি জাতীকে ডুবে মরার সঙ্গে তুলনা করেছেন। কৃপনক, স্বার্থপর, আত্মসুখমগ্ন, পরপদলেহী, ইত্যাদি হীন চরিত্রের মানুষে সমাজে ভরে গিয়েছে । সেকারণেই কবির মনে হয়েছে যে জাতী কোন না কোন কিছুর জন্য নিজে সভাকে বিক্রি করে দেয় সে জাতী নিঃশব্দ চরণে ডুবে মরছে।

৯. “অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ।” কার, কোন কবিতার অংশ ? ‘সন্তরণ' জানে না বলতে কী বুঝিয়েছেন কবি ?
 সাম্যবাদের জয় ঘোসণাকারী কবি নজরুল ইসলামের 'সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কান্ডারী হুশিয়ার” কবিতার অংশ। 
সন্তরণ না জানার বিবরণ :
        এই অসহায় জাতী নিজেদের উন্নতি বা স্বাধীনতা লাভ সম্পর্কে কোন ধারণাই পোষণ করতে পারে না। দেশমাতৃকার পরাধীনতার সীমা অতিক্রম করবার কৌশল সম্পর্কে তানভিজ্ঞতার জন্যই কবি সন্তরণ না জানার প্রসঙ্গ তুলেছেন।

১০. “কাণ্ডারী বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।" তাৎপর্য লেখ।
 সাম্যবাদের জয় ঘোষণাকারী কবি নজরুল ইসলামের “সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার অংশ। 
 তাৎপর্য :
        ইংরেজের কাছে দীর্ঘ দেড়শতাধিক বছরের পরাধীনতা কবি চিত্তে জাগিয়েছিল তীব্র বেদনা। ১৯২৬ খ্ৰীঃ সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে স্বাধীনতা আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে বাঞ্চাল হতে বসেছিল। সে সময় অভাব ছিল একজন যোগ্য নেতৃত্বের। এই পটভূমিতেই নজরুল এ কবিতা রচনা করেন। যখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনকে করে তুলেছিল বিষময়, বিষাক্ত। যারা সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত, যারা স্বার্থপর, ভণ্ড, প্রতারক, চালবাজ, পরপদলেহী তারা জানেই না স্বাধীনতালাভের প্রকৃত কৌশল কি ? আর সেকারণেই তারা একে অপরে ডুবে মরছে। সন্তান বলতে কবি এখানে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কেই বুঝিয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম হিন্দু মুসলমানের সম্মিলিত উদ্যোগ। এদের মধ্যে কোন ব্যবধানের প্রশ্নই ওঠেনা। সকলেই মায়ের সন্তান। সকলেরই একটি পরিচয় তারা মানুষ। স্বাধীনতা সংগ্রাম তাই মানুষের সংগ্রাম।

১১. “পশ্চাৎপথ যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ।' উক্তিটির তাৎপর্য লেখ ।
 সাম্যবাদের জয় ঘোষণাকারী কবি নজরুল ইসলামের “সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার অংশ। 
 তাৎপর্য :
        ‘পশ্চাৎ পথ যাত্রী' অর্থে পিছিয়ে থাকা যাত্রী মারা স্বাধীনতা সংগ্রামের কর্মী নয় কেবলমাত্র সমর্থন করে। এদেরই কবি পশ্চাৎপথ যাত্রী বলেছেন। প্রকৃত পক্ষে এই পশ্চাৎপথ যাত্রীরা হল ভীরু। এদের সমস্তকিছুতেই সন্দেহবাতিকতা। প্রকৃত পক্ষে স্বাধীনতার প্রশ্নে এদেশের নেতাদের মনে আছে নানা প্রশ্ন নানা মতান্তর। তারা স্বাধীনতার গতিকে দুর্বল করে দিয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে এই সংগ্রাম এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল মাতে আশঙ্কা হয়েছিল গণ সংগ্রাম না বিপথে চলে যায়।

১২. “গিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা, গুরু গরজায় বাজ । উদ্ধৃত অংশের তাৎপর্য লেখো।
 সাম্যবাদের জয় ঘোষণাকারী কবি নজরুল ইসলামের “সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার অংশ। 
 তাৎপর্য :
            ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগতির পথে এক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল। এই সময়ে যে সঙ্কটময় পরিস্থিতি সূচিত হয়েছিল কবি তাকে গিরি সঙ্কটের সঙ্গে তুলনা করেছে। 'গিরি সঙ্কট' শব্দের অর্থ দুই পর্বতের মাঝখানে মে সংকীর্ন পথ ।
        দেশের আপামর জনসাধারণকে কবি এখানে স্বাধীনতা লক্ষের নৌকাযাত্রী ভেবেছেন। নানা সাংসারিক বন্ধনে মুক্ত নির্লিপ্ত ও জৈবিক চাহিদা পূরণে ও জীবনের উন্মাদনায় উন্মত্ত সাধারণ মানুষের কাছে স্বাধীনতা বা পরাধীনতার কোন ফারাক নেই। তাদের উদ্বুদ্ধ করে বা অনুপ্রেরণা দিয়ে স্বাধীনতাকামী নৌ-যাত্রার সঙ্গী করা নিতান্ত সহজ ব্যাপার নয়। যাদের করা গেছে তাদেরও অনেকের মনে যে ভয় ও সংশয়ের বীজ দানা বেঁধেছে তাকে তুলে ফেলা যায় নি। এদেরকেই কবি ভীরু যাত্রী বলেছেন।

১৩. ‘কাণ্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ ত্যজিবে কি পথ মাঝ করে হানাহানি, তবু চল টানি নিয়াছ যে ডার!” উক্তিটির তাৎপর্য লেখ।
 সাম্যবাদের জয় ঘোষণাকারী কবি নজরুল ইসলামের “সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার অংশ। 
 তাৎপর্য :
        ভারতের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে নানা দ্বন্দ্ব, নানা মতান্তর, নানান জনের, নানান রকমের ভাবনা স্বাধীনতাকামী সৈনিকদের পথভ্রষ্ট করেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও জাতীবিভেজ ঐক্যকে করেছে বিঘ্নিত। তবু কবি দেশনায়কের সামনে প্রশ্ন রেখেছেন এসবের মাঝেও কি তুমি পথ ভুলে যাবে বা পথ ত্যাগ করবে। কাণ্ডারীর যে মহান দায়িত্ব তা কী পালন করবে না। শত বিপদ সত্ত্বেও তরীকে তীরে ভিড়িয়ে দেওয়াই কান্ডারীর একমাত্র লক্ষ্যও কর্তব্য। কবিও স্বাধীনতাকামী, দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনে অভিলাসী। দেশনায়কদের হানাহানি রক্তারক্তির মাঝেও যে মহাভার গ্রহণ করেছে তা পালনে সচেষ্ট হতে বলেছেন। এককথায় সামনে এগিয়ে চলাই জীবন, সেই এগিয়ে চলার আনন্দেই ভারতের স্বাধীনতার সূর্য আবার উদিত হবে।

১৪. “কাণ্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর।”- উক্তিটির তাৎপর্য লেখ।
 সাম্যবাদের জয় ঘোষণাকারী কবি নজরুল ইসলামের “সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার অংশ। 
 তাৎপর্য :
            ১৭৫৭ খ্রীঃ ২৩শে জুন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাৰ সিরাজউদ্দৌল্লাকে পরাজিত করে ইংরেজরা ভারতবর্ষে নিজেদের শাসন কায়েম করে। পলাশীর প্রান্তরের প্রসঙ্গ এনে কৰি সেই বেদনার দিককে ও বেদনাবহ ঘটনাকে আমাদের স্বস্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বাস্তবে জননায়কের সামনে পলাশীর প্রান্তর কিন্তুনা ভবিষ্যতের লক্ষ্য নয় তা কেবল অতীতের সাক্ষ্য । অতীতই তো আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাই কবি মনে করেছেন অতীতের সেই রক্তক্ষয়ী ঘটনার চিত্র চোখে ভেসে উঠলেই দেশমাতৃকার শৃঙ্খলকে মুক্ত করবার জন্য যে পণ প্রতিষ্ঠা তা আরও দৃঢ় হবে।

১৫. “বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর।”— এরকম উক্তির তাৎপর্য কী? খঞ্জর' শব্দের অর্থ কী ?
 সাম্যবাদের জয় ঘোষণাকারী কবি নজরুল ইসলামের “সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার অংশ। 
 তাৎপর্য :
        পলাশীর প্রান্তরে ভারতের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। বণিকের মানদণ্ড হয়ে যায় রাজদন্ডে রূপান্তরিত। কবি বলেছেন বাঙালীর রক্তরঞ্জিত এই পলাশীর প্রান্তর আসলে লর্ড ক্লাইভের ছুরিকাঘাতে আহত সেনানিদের রক্তধারায় আপ্লুত। 
 'খঞ্জর' শব্দটি আবী শব্দ। একধরণের ছুরিকে খঞ্জর বলা

১৬. “উদিবে সে রবি আমাদেরই খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।” 'সে রবি' বলতে কী বোঝানো হয়েছে ? কবির বক্তব্য স্পষ্ট করে লেখ।
সে রবি :
        সে রবি অর্থে কবি ভারতের স্বাধীনতা সূর্যের কথা বোঝাতে চেয়েছেন। যে আবার আমাদেরই রক্তে (খুন) আবার উদিত হবে।
কবির বক্তব্য :
        লর্ড ক্লাইভের সেনাপতিত্বে ইংরেজবাহিনী বাঙালী তথা ভারতের অসংখ্য দেশব্রতীর বুকের রক্ত ঝরিয়ে কেড়ে নিয়েছিল স্বাধীনতা। নজরুল এ কবিতাটি রচনা করেন ১৯২৬ খ্রীঃ। যখন প্রায় ১৬০ বছর ভারতবাসী পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দী। কবির বক্তব্য যে রক্তস্রোতে আমাদের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, সেই রক্ত বা খুনেই রাঙিয়ে তুলতে হবে আমাদের স্বাধীনতা সূর্যকে। সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ভুলে এক মন্ত্রে এক লক্ষ্যে সমগ্র ভারতবাসী যদি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে তবেই পূব আকাশ রাঙিয়ে আবার উদিত হবে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য।

১৭. "ফাসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান। উদ্ধৃতিটির অর্থ লেখ ।
 সাম্যবাদের জয় ঘোষণাকারী কবি নজরুল ইসলামের “সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার অংশ। 
 অর্থ :
        ভারতভূমির কঠিন শৃঙ্খালকে মুক্ত করাই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একমাত্র লক্ষ্য। দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য যারা লড়াই করেছে তাদের বিচার হয়েছে অত্যাচারী ইংরেজ শাসনের বিচারালয়ে। তাদের সেই বিচারে তাদের অনেকেরই ফাসি হয়েছে । তারা জীবনের জয়গান গেয়েছেন। পরাধীনতার কবল থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রবল ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ করবার সুমহান দায়িত্ব পালন করেছে। স্বাধীন করার এই সংগ্রামী মনোভাবকে কবি জীবনের জয়গান বলেছেন।

১৮. “আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ “ - তাৎপর্য লেখ।
 সাম্যবাদের জয় ঘোষণাকারী কবি নজরুল ইসলামের “সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার অংশ। 
 তাৎপর্য :
        নজরুল যখন এ কবিতা রচনা করছেন তখন ভারতবর্ষের দিকে দিকে চলছে জাতি বিভেদ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। কবি তাই ‘আজি' বলতে ১৯২৬ খ্ৰীঃ সমসাময়িক কালকে বুঝিয়েছেন। একই ভূখণ্ডে বসবাসকারী রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন একটা জাতীয় জনমানসকে জাতী বলা হয়। এককথায় জাতী বলতে একটা দেশের সমস্ত লোকের সমষ্টিকে বোঝায়। এরা সকলেই এক ভূখণ্ডে বাস করে। এরা যখন এক ও অভিন্ন ও ঐক্যবদ্ধ বলেদাবী করে তখনই তাদের জাতি বলে।
        জাত হল একটি ক্ষুদ্র সমষ্টি। জাতকে অন্য অর্থে বলা যায় সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমান, জৈন, খ্ৰীষ্টান, বৌদ্ধ ইত্যাদি জাত মাত্র । । অর্থাৎ জাত হল সমাজে বসবাসকারী জনমানদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র একক। এদের সকলে ও আরও অনেকে মিলিয়ে আমরা ভারতীয় জাতি।

১৯. “আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দিবে কোন বলিদান।" কার, কোন কবিতার অংশ? 'তারা' বলতে কবি কাদের বুঝিয়েছেন?
 সাম্যবাদের জয় ঘোষণাকারী কবি নজরুল ইসলামের “সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার অংশ। 
 তারা’র পরিচয় :
        ভারতবাসীকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে কত বিপ্লবী হাসিমুখে তাদের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। তাদের কাছে জীবন পণ স্বরূপ । হয় মুক্তি, নয় প্রাণ দান এই তাদের প্রতিজ্ঞা। কবি এখানে তারা বলতে সেই মুক্তি পিয়াসী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বুঝিয়েছেন।

২০. “আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দিবে কোন বলিদান।" কার, কোন কবিতার অংশ? কবি কাদের কোন্ বলিদানের কথা বলেছেন ?
 সাম্যবাদের জয় ঘোষণাকারী কবি নজরুল ইসলামের “সর্বহারা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার অংশ। 
 বলিদান :
             কবি এখানে এইসব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করার কথাকে উল্লেখ করেছেন। দেশপ্রেমী সৈনিকরাই দেশের মুক্তি সাধনার বেদীমূলে নিজেদের বলিদান দেবে। দেশের স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যেই তাদের এই বলিদান। যে বলিদানের মধ্য দিয়ে তারা অমর হয়েছেন। কবির প্রশ্ন শহীদেরা প্রাণ দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের যে পথকে ত্বরান্বিত করেছিল, আজ এই সঙ্কটময় মুহূর্তে জননেতা বা দেশরতীরা কি তা ভুলে যাবেন ? কবি শহীদদের করা স্মরণ করিয়ে দেশরতীদের প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তা আনতে চান। তাই তিনি এই বলিদানের প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করেছেন।

No comments