Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

‘আফ্রিকা’ কবিতার আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর :

  দশম শ্রেণীর ‘সাহিত্য সঞ্চয়ন’ বইয়ের প্রতিটি বিষয় আমাদের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে । আজকের আলোচনা ‘আফ্রিকা’ । ‘‘আফ্রিকা”         ...

 দশম শ্রেণীর ‘সাহিত্য সঞ্চয়ন’ বইয়ের প্রতিটি বিষয় আমাদের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে । আজকের আলোচনা ‘আফ্রিকা’ ।


‘‘আফ্রিকা”
                                         -- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর      

               মূল কবিতা               

উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে
স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে 
নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত, 
তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা নাড়ার দিনে
রুদ্র সমুদ্রের বাহু
প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে 
ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে, আফ্রিকা— 
বাঁধলে তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায় 
কৃপণ আলোর অন্তঃপুরে।
সেখানে নিভৃত অবকাশে তুমি 
সংগ্রহ করছিলে দুর্গমের রহস্য, 
চিনছিলে জলস্থল-আকাশের দুর্বেধি সংকেত, 
প্রকৃতির দৃষ্টি-অতীত জাদু
মন্ত্র জাগাচ্ছিল, তোমার চেতনাতীত মনে।
বিদ্রূপ করছিলে ভীষণকে 
বিরুপের ছদ্মবেশে,
শঙ্কাকে চাচ্ছিলে হার মানাতে 
আপনাকে উগ্র ক'রে বিভীষিকার প্রচণ্ড মহিমায়
তাণ্ডবের দুন্দুভিনিনাদে ৷৷

হায় ছায়াবৃতা,
কালো ঘোমটার নীচে
অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ
উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।
এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে,
নখ যাদের তীক্ষ্ম তোমার নেকড়ের চেয়ে,
এল মানুষ-ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।
সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।
তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ্যপথে
পঙ্কিল হলো ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে,
দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়
বীভৎস কাদার পিণ্ড
চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে ৷৷

সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায় 
মন্দিরে বাজছিল পূজার ঘণ্টা 
সকালে সন্ধ্যায় দয়াময় দেবতার নামে; 
শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে;
কবির সংগীতে বেজে উঠেছিল
সুন্দরের আরাধনা।

আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে
প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস,
যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল— 
অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল,
এসো যুগান্তের কবি,
আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে 
দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে;
বলো ‘ক্ষমা করো’–
হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী৷৷


    লেখক পরিচিতি :    
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১–১৯৪১): জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। অল্পবয়স থেকেই ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ভারতী ও বালক পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। দীর্ঘ জীবনে অজস্র কবিতা, গান, ছোটোগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন। এশিয়ার মধ্যে তিনিই প্রথম নোবেল পুরস্কার পান ১৯১৩ সালে 'Song Offerings' এর জন্যে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত আর বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত তার রচনা। কবির প্রথম জীবনে লেখা কাব্যগ্রন্থগুলি হলো– 'সন্ধ্যাসগীত', 'প্রভাতসঙ্গীত', 'ছবি ও গান', 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' এবং 'কড়ি ও কোমল'।১৮৮৮ থেকে ১৮৯৬ – মাত্র আট বছরে কবি প্রতিভার যে অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে তারই চিহ্ন সুমুদ্রিত এই পর্বের চারখানি। কাব্যগ্রন্থে – 'মানসী', 'সোনারতরী', 'চিত্রা’ ও ‘চৈতালি 'তে। এই পর্বের কাব্যগুলিতে কবির আত্মোপলব্ধিই শুধু নয়, তাঁর কাব্যে নির্মাণ কৌশলেরও যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। আবেগ, গভীর আত্মপ্রত্যয় জীবন জিজ্ঞাসা, কল্পনার পক্ষ বিস্তার, শিল্পরূপ নির্মাণে দক্ষতা, ভাষা ও ছন্দের ওপর আধিপত্য প্রভৃতি কবির যাবতীয় গুণাবলির প্রকাশ ঘটেছে এই পর্বের কবিতাবলিতে। এরপর কবি রচনা করেন কণিকা, কথা ও কাহিনী, কল্পনা, ক্ষণিকা ও নৈবেদ্য গীতাগুলি পর্বের প্রধান তিনখানি কাব্যগ্রন্থ গীতালি, গীতিমাল্য ও গীতালি, ১৯১৬তে বলাকা, ১৯২৫ এ পুরবী এবং ১৯২৯-এ মহুয়া রচনা করেন কবি রবীন্দ্রনাথ। 'পুনশ্চ' থেকে রবীন্দ্রকাব্যের শেষ পর্বের শুরু। এ পর্বের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হলো শেষ সপ্তক', 'প্রান্তিক', 'নবজাতক', 'সামাই', 'রোগশয্যায়', 'আরোগ্য ইত্যাদি।

     উৎস :       
        রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সঞ্চয়িতা’ কাব্য সংকলন থেকে গৃহীত হয়েছে। তবে এটি স্বতন্ত্রভাবে ‘পত্রপুট’ কাব্যগ্রন্থের ষোলো সংখ্যক কবিতায় স্থান পেয়েছে।

    বিষয় অল্প কথায়:    
  •  আদিম আফ্রিকার প্রাকৃতিক রহস্যময়তায় ঢাকা সৌন্দর্যের বর্ণনা
  •  আদিম রূপের রহস্যের ভয়ংকরতার কারণে একদিকে তার টিকে থাকা আর অন্য দিকে তার উপেক্ষিত হওয়া
  • ক্রীতদাসের জোগানেই যার শুধু ভূমিকা ছিল তার সম্পদশালী রূপ অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে প্রকাশ্যে আসায় সাম্রাজ্যলোভীদের আগ্রাসনের শুরু
  • সভ্য দুনিয়ার মানুষের শোষণ লাঞ্ছনার শিকার আফ্রিকার বেদনায় কবির ব্যথিত হওয়া
  • ইউরোপীয়দের বর্বরোচিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানবতা প্রতিষ্ঠার বাণী উচ্চারণ

    নামকরণের খুঁটিনাটি :    
  •  ব্যঞ্জিত নামকরণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রে থাকা আফ্রিকার নানা রূপে অবস্থান
  • রহস্যেঘেরা আফ্রিকার অন্ধকারে আচ্ছন্ন রূপ। সেই আফ্রিকারই সৃষ্টির আদিম রহস্যভেদ করে প্রকাশ্যে আসা 
  • আফ্রিকার সম্পদের লোভে সভ্য দুনিয়ার মানুষদের শোষণ-লাঞ্ছনা
  • সবশেষে অপমানিত ইতিহাস ভেদ করে মানবতার পথে উত্তোরণের জয়গানও সেই আফ্রিকাকে ঘিরেই

     নির্বাচিত প্রশ্নোত্তর :    

১) ‘স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে’ – ‘স্রষ্টা কে? তিনি নিজের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন কেন? 
 রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ কবিতা থেকে অংশটি গৃহীত। যিনি সৃষ্টি করেন তিনিই স্রষ্টা। এখানে কবি ঈশ্বরকেই ‘স্রষ্টা’ বলে অভিহিত করেছেন। 
অসন্তুষ্টির কারণ :
    স্রষ্টার ততক্ষণ পর্যন্ত সন্তুষ্টি হয় না যতক্ষণ না তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিজের মনোমতো হয়। সেই সত্যকে কল্পনা করেই কবি বলতে চেয়েছেন সৃষ্টির আদিম লগ্নে ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টিকে বারবার ধ্বংস করে নতুনভাবে গড়ে তুলছিলেন। কিন্তু তা কখনোই তাঁর মনোমতো হচ্ছিল না। এই কারণে তিনি নিজের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন।

২) ‘ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে, – ‘তোমাকে’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? কে তাকে কোথা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল?
অথবা, “ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে’– ‘তোমাকে’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? এই উত্তির মধ্য দিয়ে কবি কী বুঝিয়েছেন?
 রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ কবিতায় ‘তোমাকে’ বলতে আফ্রিকা মহাদেশকে বোঝানো হয়েছে।
আলোচনা :
        আদিম পৃথিবীর বুকে ঘটে যাওয়া ভৌগোলিক বিবর্তনকে এখানে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন এক আশ্চর্য ব্যঞ্জনায়। বৈজ্ঞানিকদের মতে টেকটনিক প্লেটগুলির নড়াচড়ার ফলেই এশিয়ার মূল ভূখণ্ড } এই থেকে আফ্রিকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কবি এরই কাব্যিক রূপ দিয়ে বলেছেন, রুদ্র সমুদ্র মূল ভূখণ্ড থেকে আফ্রিকাকে ছিনিয়ে নিয়ে যেন বনস্পতির নিবিড় পাহারায় কৃপণ আলোর অন্তরালে তাকে নিক্ষেপ করেছিল।

৩) ‘হায় ছায়াবৃতা, – 'ছায়াবৃতা’ কে? তাকে ছায়াবৃতা বলার কারণ কী?
‘অথবা, ‘অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ' বলার কারণ কী?
 রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আফ্রিকা' কবিতায় আফ্রিকা মহাদেশকে ছায়াবৃতা’ বলে সম্বোধন করেছেন।
 ছায়াবৃতা বলার কারণ :
    ‘ছায়াবৃতা’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ছায়া দ্বারা আবৃতা বা ছায়াঢাকা। দুর্গম অরণ্যে ঘেরা আফ্রিকা মূল ভূখণ্ড থেকে বহুদূরে অবস্থিত। আধুনিক সভ্যতা ও জ্ঞানের আলো থেকে সে বঞ্ছিত। দুর্গমতার কারণে উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ ও নিজস্ব সংস্কৃতি বাকি বিশ্বের কাছে অজানাই রয়ে গেছে তার রহস্যময় অরণ্যের মতোই।

৪)‘দাড়াও মানহারা মানবীর দ্বারে’ - কাকে ‘মানহারা মানবী’ বলা হয়েছে ? তাকে আহ্বান করার কারন কি ?
 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ আফ্রিকা’ কবিতায় ‘মানহারা মানবী’ বলতে ‘আফ্রিকার’ কথা বলা হয়েছে ।
আহ্বানের কারন :
    ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের পায়ের কাঁটা মারা জুতোর তলায় ক্ষত বিক্ষত হয়েছে আফ্রিকার মাটি । সভ্য মানুষ কখনো ফিরে তাকায় নি মানহারা মানবীর দিকে । যুগান্তরের কবি সভ্য মানুষের প্রতিনিধি । তাই মানহারা আফ্রিকার দ্বারে দাঁড়িয়ে সমগ্র সভ্য মানুসের হয়ে তাকে ক্ষমা চাইতে হবে । এই কারনেই কবি তাকে আহ্বান করেছেন ।

৫) ‘এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে’ - ওরা কারা ? ওদের হাতকড়ি নিয়ে আসার কারন কি ?
 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ আফ্রিকা’ কবিতায় ‘ওরা’ বলতে অত্যাচারী ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের কথা বলা হয়েছে ।
হাতকড়ি নিয়ে আসার কারণ :
        ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের পায়ের কাঁটা মারা জুতোর তলায় ক্ষত বিক্ষত হয়েছে আফ্রিকার মাটি। অত্যাচারী ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা এসে আফ্রিকার মানুষদের বন্দি করে ক্রীতদাসে পরিনত করে । এই ক্রীতদাসদের বন্দি করার জন্য হাতকড়ি নিয়ে আসেন ।

৬) ‘চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে’ - কারা কিভাবে কিসের চিরচিহ্ন দিয়ে গেল ?
 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ আফ্রিকা’ কবিতায় ‘ওরা’ বলতে অত্যাচারী ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের কথা বলা হয়েছে ।
 চিরচিহ্নের মুদ্রন :
        সৃষ্টির সূচনা থেকে আফ্রিকা অরণ্যাবৃত । তথাকথিত সভ্য ইউরোপীয় সভ্যতার চোখেও আফ্রিকা ছিল উপেক্ষিত । আফ্রিকার সম্পদের সন্ধান পেতে এই শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক তথা সাম্রাজ্যবাদীর দল শুরু করে মানবিক লাঞ্ছনা । এইসব অত্যাচারিত মানুষের রক্ত ও অশ্রুতে কর্দমাক্ত হয় আফ্রিকার বনপথের ধুলো । সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের কাঁটা মারা জুতোর তলার কাদার পিন্ড এভাবেই আফ্রিকার অপমানিত ইতিহাসে চিরচিহ্ন দিয়ে গেল ।

৭) ‘এসো যুগান্তেরের কবি’ - কবি কখন যুগান্তরের কবিকে আহ্বান করেছেন ? যুগান্তরের কবিকে কবি কোন উপদেশ শোনাবেন ?
 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ আফ্রিকা’ কবিতায় কবি দেখতে পেলেন দিনের অন্তিম কালে পশ্চিম দিগন্তে অর্থাৎ ইউরোপের দেশে দেশে ‘প্রদোষকাল ঝঞ্ঝা বাতাসে রুদ্ধশ্বাস’ ‘গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল । ঠিক সেই সময়ে কবি যুগান্তরের কবিকে আহ্বান করেছেন ।
 উপদেশ :
        আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাত যখন প্রকৃতিকে অন্য এক মাত্রা দিয়েছে তখন ক্রান্তদর্শী কবি রবীন্দ্রনাথ যুগান্তেরের কবিকে মানহারা মানবীর দ্বারে অর্থাৎ অপমানিত ইতিহাসের রূপাঙ্কনের বাস্তব ভূমিতে দাঁড়িয়ে হিংস্র প্রলাপের মধ্যে ‘ক্ষমা করো’র মতো উপদেশ শোনাবেন ।

৮) ‘কৃপন আলোর অন্তঃপুরে’-কবিতা অনুসারে বক্তব্যটি লেখ।
 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ আফ্রিকা’ কবিতা থেকে আলোচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে ।
বক্তব্য :
    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত আফ্রিকা কবিতায় আফ্রিকার ভৌগোলিক, রাজনৈতিক সম্পর্কে মরমি বিশ্লেষণ রয়েছে। বনস্পতির নিবিড় আলিঙ্গনে, অরণ্যের দুর্ভেদ্য আলো ছায়ায় আবৃত থাকে আফ্রিকা। নিরক্ষীয় জলবায়ুর অন্তর্গত হওয়ার জন্য বৃহৎ পাতা বিশিষ্ট গাছের সৃষ্টি হয় এখানে। অসংখ্য বৃক্ষ ঘন সন্নিবিষ্ট হওয়ায় অতি সামান্য আলোটুকু প্রবেশের অধিকার পায় না। অন্ধকারে আবৃত থাকে আফ্রিকার অধিকাংশ প্রান্তর।

৯) ‘বিদ্রপ করেছিল ভীষণকে’ -- কে কিভাবে ভীষণকে বিদ্রুপ করেছিল?
 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ আফ্রিকা’ কবিতা থেকে আলোচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে ।
ভীষণকে ব্যঙ্গ :
        আফ্রিকা নামাঙ্কিত কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃথিবীর অন্য মহাদেশ থেকে বিছিন্ন আফ্রিকাকে ধীরে ধীরে সাবলম্বী হতে দেখেছিলেন। নিভৃত অবকাশে দুর্গমের রহস্য সংগ্রহ করেছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এ ভূখন্ড। চিনেছিল জল, স্থল। আকাশের দুর্বোধ সংকেত। প্রকৃতি তাকে দিয়েছিল অপার রহস্যময়তা। অতীত জাদু মন্ত্র জাগাচ্ছিল আফ্রিকার চেতনাতীত মনে। আফ্রিকার ওপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আস্ফালনকে আফ্রিকা নিজেই চিনে নিতে চাইছিল। সেই ভীষণ শক্তিশালী শক্তিকে ব্যঙ্গ করার স্পর্ধা অর্জন করেছিল।

১০) ‘নখ যাদের তীক্ষ্ন তোমার নেকড়ের চেয়ে’ - তোমার বলতে কাদের কথা বলা হয়েছে, কাদের নখ কেন নেকড়ের থেকে তীক্ষ্ন ?
 তোমার বলতে আফ্রিকা মহাদেশের কথা বলা হয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হিংস্রতা :
        দুর্ভেদ্য জঙ্গলে পরিবৃত আফ্রিকার হিংস্র আরণ্যক প্রাণীদের অন্যতম হল নেকড়ে। নেকড়ের তীক্ষ্ন নখের থেকেও সূচালো ও ধারালো হল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন। পশ্চিমী দুনিয়া আফ্রিকার ওপর বর্বর উল্লাসে ঝাপিয়ে পড়ে। এদের আগ্রাসনের কথা বলতে গিয়ে কবি ‘নখ যাদের তীক্ষ্ন এই বাক্য বন্ধটি প্রয়োগ করে দুনিয়ার লোলুপ হিংস্রতাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছেন। কবি এখানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে আলােচ্য উক্তিটি প্রকাশ করেছেন।

১১) “বাঁধলে তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায়’ - বনস্পতির নিবিড় পাহারা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ আফ্রিকা’ কবিতা থেকে  নেওয়া প্রশ্নোধৃত অংশে আফ্রিকার কথা বলা হয়েছে ।
বনস্পতির নিবিড় পাহারা’ :
        আফ্রিকা মহাদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল, বিশেষত, মধ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকায় নিরক্ষীয় অঞ্চল হওয়ার জন্য ঘন অরণ্য রয়েছে। সেই নিবিড় অরণ্য ভেদ করে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। প্রকৃতি যেন নিবিড়, নিছিদ্র পাহারায় বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে আফ্রিকাকে। এই ভৌগোলিক সত্যকেই রবীন্দ্রনাথ কাব্যিকভাবে তুলে ধরেছেন।

১২) "আপনাকে উগ্র করে বিভীষিকার প্রচন্ড মহিমায়” -- প্রসঙ্গটি ব্যাখ্যা করাে।
 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ আফ্রিকা’ কবিতা থেকে আলোচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে ।
ব্যাখ্যা :
        সভ্যতাসৃষ্টির প্রথম পর্বে আফ্রিকা বাইরের পৃথিবীর কাছে নিজেকে পরিচিত করেছিল তার ভয়ংকর স্বরূপের মধ্য দিয়ে। আফ্রিকার প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাই একসময় তাকে রক্ষা করেছিল বহিঃশক্তির হাত থেকে। তার দুর্ভেদ্য অরণ্য ভেদ করে প্রবেশ করার অধিকার সূর্যরশ্মিরও ছিল না। বিরূপের ছদ্মবেশে আফ্রিকা যেন ভীষণ বহিঃপ্রকৃতিকে বিদ্রুপ করেছিল। নিজের ভয়কে সে জয করেছিল বিভীষিকাকে আশ্রয করে।

১৩)  ‘এল মানুষ ধরার দল' – কবি কাদের কথা বলেছেন? তাদের স্বরূপ বিচার করো।
 কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আফ্রিকা’ কবিতায় ‘মানুষ-ধরার দল’ বলতে নির্দয় ও হিংস্র সাম্রাজ্যবাদী শাসকের কথা বলেছেন।
স্বরূপ বিচার :
        শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক শক্তির লাঞ্ছনা এবং নির্যাতনে আফ্রিকার বনজঙ্গল বারংবার রক্তাক্ত হয়েছিল। তাদের নির্বিচার খুন ও হত্যার নৃশংসতায়; তারা হয়ে উঠেছিল বন্য নেকড়ের চেয়েও হিংস্র এবং কদর্য। অবক্ষয়ী এই তথাকথিত সভ্যরা ছিল দাস-ব্যবসায়ী। কবির মতে নিরীহ মানুষকে পণ্য হিসেবে কেনাবেচা করার মিথ্যা গর্ব কিংবা অহমিকা আসলে এদের অসভ্য অমানবিকতার প্রকাশ। ইউরোপীয় শাসককুলের বর্বর লোভের এই ঘৃণ্য-করুণ ইতিহাসটিই কখনও ‘এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে’ কিংবা ‘এল মানুষ-ধরার দল' শব্দবন্ধের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

১৪) ‘‘অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ/ উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে”- মন্তব্যটির তাৎপর্য লেখো।
 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ আফ্রিকা’ কবিতা থেকে আলোচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে ।
তাৎপর্য :
            আদিম অরণ্য আর মরুভূমি অধ্যুষিত আফ্রিকা এক দীর্ঘ সময় ছিল বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগহীন । উন্নত পৃথিবী মুখ ফিরিয়ে থেকেছে আফ্রিকার থেকে। রবীন্দ্রনাথ তাকে বলেছেন 'ছায়াবৃতা', আর সাংবাদিক হেনরি স্ট্যানলি আফ্রিকা সম্পর্কে দিয়েছিলেন সেই বহুশ্লুত বিশেষণ 'ফধৎশ পড়হঃরহবহঃ' । ইতিহাস প্রমাণ করে উনবিংশ শতাব্দীর আগে কোনো ইউরোপীয় শক্তি আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনের কথা ভাবেনি। আফ্রিকার সম্পদ এবং সংস্কৃতি এভাবেই উপেক্ষিত হয়েছিল সভ্য সমাজের দ্বারা।

১৫) ‘সেই হোক সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।। সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণীটি কী? বিষয়টি ব্যাখ্যা করে লেখো।
 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতা অনুসারে সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণীটি হল, শ্বেতাঙ্গ শাসকের অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত আফ্রিকার কাছে নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা।
বিষয়ের ব্যাখ্যা :
        সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে চিরকাল আফ্রিকা শোষিত ও অত্যাচারিত হয়েছে। তারা নির্বিচারে সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করেছে, বন্যপ্রাণী আর মানুষদের হত্যা করেছে কিংবা ক্রীতদাসে পরিণত করেছে। আফ্রিকার নিরীহ, নিরপরাধ জনগণের ঘামে, রক্তে ও কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে সে দেশের মাটি ও বাতাস। এ ইতিহাস লাঞ্ছনা, বঞ্চনা এবং অপমানের। তাই এমন অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে মানবতাবাদী কবি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে বিশ্বব্যাপী হিংস্র প্রলাপের মধ্যে আফ্রিকার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সকলকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

No comments