রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির কাছে বিশেষ একটি নাম। বাংলা সাহিত্যের তিনি একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং তাঁর বিশাল সাহিত্য কীর্তির জন্য তিনি বহু বাঙালি...
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির কাছে বিশেষ একটি নাম। বাংলা সাহিত্যের তিনি একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং তাঁর বিশাল সাহিত্য কীর্তির জন্য তিনি বহু বাঙালির রক্তস্রোতে আজও মিশে আছেন। তিনি ছিলেন একাধারে বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতকার, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক। এক কথায় বহুমুখী প্রতিভার সম্বন্বয় ঘটেছিল তাঁর বর্ণময় দীর্ঘ কর্মজীবনে।
‘রবীন্দ্র কাব্য পরিক্রমা’ (পর্ব - ০১ এবং পর্ব - ০২ ) তে আমরা রবীন্দ্রনাথেরে কাব্যের ‘সূচনা’ ও ‘উন্মেষ’, ‘ঐশ্বর্য পর্ব' , ‘অর্ন্তবর্তী’ ও ‘গীতাঞ্জলি’ পর্ব সম্পর্কে জেনেছি । আজ আমরা ‘বলাকা ও অন্তরাগ’ পর্ব সম্পর্কে জানবো ।
আরো পড়ুন : রবীন্দ্র কাব্য পরিক্রমা (পর্ব - ০১)
আরো পড়ুন : রবীন্দ্র কাব্য পরিক্রমা (পর্ব - ০২)
[6] ‘বলাকা’ পর্ব (১৯১৬ - ২৯ খ্রি.):
সময়কাল : ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তেরো বৎসরের মধ্যে কবির যে কাব্যগুলি প্রকাশিত হয়, সেই কাব্যগুলির সময় কালকে ‘বলাকা পর্ব' আখ্যা দিতে পারি ।
কাব্যগ্রন্থ :
- ‘বলাকা’ (১৯১৬)
- ‘পলাতকা’ (১৯১৮)
- ‘লিপিকা’ (১৯২২)
- ‘শিশু ভোলানাথ’ (১৯২২)
- ‘পূরবী’ (১৯২৫)
- ‘প্রবাহিনী’ (১৯২৫)
- ‘লেখন’ (১৯২৭)
- ‘মহুয়া’ (১৯২৯)
মনে রাখার কৌশল : ‘বলাকা’ পর্বে : বলাকার পালানো দেখে লিপিকা শিশু ভোলানাথকে ডেকে বলল - পূরবীর জন্য সব হল । কে বলেছিল ওকে নদীর (প্রবাহিনীর) ধারে বসে জোরে জোরে লেখা (লেখনী) মুখস্ত করতে ? এটা নিশ্চয়ই মহুয়ার কাজ !!
বলাকার = ‘বলাকা’ (১৯১৬)
পালানো = ‘পলাতকা’ (১৯১৮)
লিপিকা = ‘লিপিকা’ (১৯২২)
শিশু ভোলানাথকে = ‘শিশু ভোলানাথ’ (১৯২২)
পূরবীর জন্য = ‘পূরবী’ (১৯২৫)
নদীর = ‘প্রবাহিনী’ (১৯২৫)
লেখা মুখস্ত করতে = ‘লেখন’ (১৯২৭)
মহুয়ার কাজ = ‘মহুয়া’ (১৯২৯)
আলোচনা :
(১) ‘বলাকা :
- ‘বলাকা’ পর্বের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ।
- কাব্যটি ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
- এই কাব্যে জড়ত্ব: নস্যাৎ করে গতিবাদের জয় ঘােষণা করা হয়েছে।
- কাব্যটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর বন্ধু উইলি পিয়র্সনকে উৎসর্গ করেন ।
- এই কাব্যে ৪৫টি কবিতা আছে ।
- "বলাকা” কাব্যে গতিবেগের কবিতাগুলি হল -- উত্তর:- বলাকা', 'সাজাহান”, “ছবি', 'চঞ্চল” প্রভৃতি।
- এই কাব্যের উল্লেখযোগ্য কবিতা - ‘সাজাহান’ , ‘ছবি’ , ‘বলাকা’, ‘ঝড়ের খেয়া’, ‘সবুজের অভিযান’, ‘শঙ্খ’।
(২) ‘পলাতকা’ :
- সমকালীন রাজনৈতিক উত্তেজনা ও নারীদের করুন কাহিনীর উপর ভিত্তি করে এই কাব্য রচিত ।
- এই কাব্যে গল্প-কবিতার আকারে রবীন্দ্রনাথ নারীজীবনের সমসাময়িক সমস্যাগুলি তুলে ধরেছেন।
- কাব্যটি ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ।
- এই কাব্যের উল্লেখযোগ্য কবিতা - ‘পলাতকা’, ‘মুক্তি’, ‘ফাঁকি’, ‘কালো মেঘ’ ইত্যাদি।
(৩) ‘লিপিকা’ :
- কাব্যটি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
- এই কাব্যটি এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত হয় ।
- এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘পায়ে চলার পথ’ ।
- কাব্যটি কবি কাউকে উৎসর্গ করেন নি ।
(৪) ‘শিশু ভোলানাথ’ :
- কাব্যটি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
- এই কাব্যটির বেশির ভাগ কবিতা একজন নীরব মাকে উদ্দেশ্য করে রচিত ।
- এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘অন্য মা’ ।
- এই কাব্যটিতে শিশুর ইচ্ছা, কল্পনা, অদম্য সাহসিকতার পরিচয় ফুটে উঠেছে ।
(৫) ‘পূরবী’ :
- কাব্যটি ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
- এই কাব্যের পটভূমিকা উল্লেখ রয়েছে ‘পশ্চিমযাত্রীর ডায়েরী’তে ।
- এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘পূরবী’ ।
- এই কাব্যটিতে মোট ৭৮টি কবিতা রয়েছে ।
- এই কাব্যের বেশিরভাগ কবিতাই কবি দক্ষিণ আফ্রিকা যাত্রাকালেরেচনা করেন ।
- এই কাব্যে কবি তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তির আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন ।
- এই কাব্যটি উৎসর্গ করেন আর্জেন্টিনার কবি Victor Ocampo কে।
(৬) ‘প্রবাহিনী’ :
- কাব্যটি ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
- এই কাব্যটির বেশির ভাগ কবিতা একজন নীরব মাকে উদ্দেশ্য করে রচিত ।
- এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘অন্য মা’ ।
- এই কাব্যটিতে শিশুর ইচ্ছা, কল্পনা, অদম্য সাহসিকতার পরিচয় ফুটে উঠেছে ।
(৭) ‘লেখন’ :
- কাব্যটি ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
- এই কাব্যটি মূলত অপ্রধান রচনা ।
- এই কাব্যগ্রন্থের লেখাগুলি শুরু হয়ে চীন ও জাপানে ।
- পাখায়, কাগজে, রুমালে কিছু লিখে দেবার জন্যে লোকের অনুরোধে এই কাব্যের লেখাগুলির উৎপত্তি।
- অন্যমনস্কতার কারণে এই লেখাগুলিতে ভৎঅনেক ভুল লক্ষ্য করা যায় । পরে অবশ্য সেগুলি সংশোধিত হয়েছে।
(৮) ‘মহুয়া’ :
- কাব্যটি ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
- এই কাব্যের অধিকাংশ কবিতা ১৩৩৫ সালের শ্রাবন মাস থেকে পৌষ মাসের মধ্যে লেখা ।
- এই কাব্যটি প্রেমমূলক কাব্য ।
- কবি সাতষট্টি বছর বয়সে এই কাব্যখানি রচনা করেন ।
- এই কাব্যের বিখ্যাত কবিতা - ‘মহুয়া’, ‘সবলা’ ।
[7] ‘অন্তরাগ’ পর্ব (১৯৩০ - ৩৭ খ্রি.):
সময়কাল : ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সাত বৎসরের মধ্যে কবির যে কাব্যগুলি প্রকাশিত হয়, সেই কাব্যগুলির সময় কালকে ‘অন্তরাগ পর্ব' আখ্যা দিতে পারি ।
কাব্যগ্রন্থ :
- ‘বনবানী’ (১৯৩১)
- ‘পরিশেষ’ (১৯৩২)
- ‘পুনশ্চ’ (১৯৩২)
- ‘বিচিত্রতা’ (১৯৩৩)
- ‘শেষ সপ্তক’ (১৯৩৫)
- ‘বীথিকা’ (১৯৩৫)
- ‘পত্রপূট’ (১৯৩৬)
- ‘শ্যামলী’ (১৯৩৬)
- ‘খাপছাড়া’ (১৯৩৭)
- ‘ছড়া ও ছবি’ (১৯৩৭)
মনে রাখার কৌশল : ‘অন্তরাগ পর্বে : বনবানী বহুদিন বিদেশে কাটানোর পর পরিশেষে পুনশ্চকে নিয়ে গ্রামে ফিরে এলেন । গ্রামের বিচিত্র পরিবেশ তাকে মুগ্ধ করে । শেষ সপ্তাহে বীথিকাকে পত্র লিখে শ্যামলী সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল । কিন্তু কোনো উত্তর আসে নি । চিঠিটা হয়তো খাপছাড়া ভাবে লেখা হয়েছিল । তাই গ্রামে আসতেই হল । গ্রামের পরিবেশ তার কাছে ছড়া ও ছবির মতো মনে হচ্ছিল ।
বনবানী = ‘বনবানী’ (১৯৩১)
পরিশেষে = ‘পরিশেষ’ (১৯৩২)
পুনশ্চকে নিয়ে = ‘পুনশ্চ’ (১৯৩২)
বিচিত্র পরিবেশ = ‘বিচিত্রতা’ (১৯৩৩)
শেস সপ্তাহে = ‘শেষ সপ্তক’ (১৯৩৫)
বীথিকাকে = ‘বীথিকা’ (১৯৩৫)
পত্র লিখে = ‘পত্রপূট’ (১৯৩৬)
শ্যামলী সম্পর্কে= ‘শ্যামলী’ (১৯৩৬)
খাপছাড়া ভাবে = ‘খাপছাড়া’ (১৯৩৭)
ছড়া ও ছবির মতো = ‘ছড়া ও ছবি’ (১৯৩৭)
আলোচনা :
(১) ‘বনবানী :
- ‘অন্তরাগ’ পর্বের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ।
- কাব্যটি ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
- এই কাব্যে কবির মানব জীবন ও পরিবেশে উদ্ভিতের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তথ্য রয়েছে।
- এই কাব্যের প্রথম কবিতা - ‘বৃক্ষবেদনা’ ।
(২) ‘পরিশেষ’ :
- অতুলপ্রসাদ সেনকে কবি এই কাব্য উৎসর্গ করেন ।
- কাব্যটি ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ।
- এই কাব্যের উল্লেখযোগ্য কবিতা - ‘আছি, বালক, নতুন শ্রোতা’ ইত্যাদি।
- এই কাব্যে কবির মনে মৃত্যু চিন্তা ভর করেছে -- তারই প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় ।
- এই কাব্যকে ‘কবির জীবনম্মৃতি’ বলা হয় ।
(৩) ‘পুনশ্চ’ :
- কাব্যটি ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
- এই কাব্যটি ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে প্রকাশিত হয় ।
- কাব্যটি গদ্য কাব্য।
- ‘পুনশ্চ’ কথার অর্থ - পুনরায় শুরু । এই কাব্য কবির জীবনের নতুন নতুন পালার নান্দীপাঠ।
- ভাইপো নীতুকে কাব্যটি উৎসর্গ করেন ।
(৪) ‘বিচিত্রতা’ :
- কাব্যটি ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
- এই কাব্যটির বেশির ভাগ কবিতা পাঁচমেশালী।
- কাব্যটি গদ্য ছন্দে রচিত ।
(৫) ‘শেষ সপ্তক’ :
- কাব্যটি ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
- কাব্যটি গদ্য ছন্দে রচিত ।
- এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিতে রবীন্দ্র জীবনের বিষাদের সুর অনুভূত হয় ।
- এই কাব্যের প্রথম কবিতা - ‘স্থির জেনেছিলাম, পেয়েছি তোমাকে ’।
(৬) ‘বীথিকা’ :
- কাব্যটি ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
- এই কাব্যগ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘দুর্ভাগিনী’, ‘নিমন্ত্রণ’ ইত্যাদি ।
- কাব্যটি গদ্য ছন্দে রচিত ।
(৭) ‘পত্রপূট’ :
- কাব্যটির প্রকাশকাল ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দ ।
- ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের ২৫বৈশাখ কাব্যটি প্রকাশিত হয় ।
- এই কাব্যগ্রন্থটি কৃৃৃষ্ণ কৃৃপালানি ও শ্রীমতী নন্দিতাকে তাঁদের শুভ পরিণয় উৎসব উপলক্ষ্যে উৎসর্গ করেন ।
- এই কাব্যের কাব্যের প্রথম কবিতা - ‘জীবনে নানা সুখদুঃখের এলোমেলো ভিড়ের মধ্যে’ ।
- কাব্যটি গদ্য ছন্দে রচিত ।
(৮) ‘শ্যামলী’ :
- কাব্যটি ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
- এই কাব্যটি রাণী মহলানবীশকে উৎসর্গ করেন ।
- কাব্যটি গদ্য ছন্দে রচিত ।
- এই কাব্যে ২০টি কবিতা আছে ।
- ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের জ্যোষ্ঠ মাস থেকে ভাদ্রমাসের মধ্যে কবিতগুলি রচিত হয় ।
- এই কাব্যের ‘কনি’, হঠাৎ দেখা’, অমৃত’ দুর্বোধ ও বঞ্চিত এই পাঁচটিকে গদ্যকবিতায় ছোটগল্প বলা যেতে পারে ।
- ‘শেষ পহরে’ সম্ভাষণ, ও ‘অকাল ঘুম’ এই তিনটি গল্পিকা ।
(৯) ‘খাপছাড়া’ :
- কাব্যটি ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
- এই কাব্যটি রাজশেখর বসুকে উৎসর্গ করেন ।
- এই কাব্যকে ছড়ার সংকলনও বলা যায় ।
- এই কাব্যগ্রন্থের লেখাগুলি শিশুকেন্দ্রীক ।
- এই কাব্যের প্রথম কবিতা - ‘ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ির পাঁচ বোন থাকে কাল্নায়’ ।
(১০) ‘ছড়া ও ছবি’ :
- কাব্যটি ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
- কবি কাব্যটি বউমা প্রমিতা দেবীকে উৎসর্গ করেন ।
পরবর্তী অংশ ‘রবীন্দ্র কাব্য পরিক্রমা (পর্ব - ০৪)’ - খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হবে ।
খুব সুন্দর ...
ReplyDeleteধন্যবাদ