Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

কাব্য সাহিত্যে মধুসূদন দত্ত :

... একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পাঠাইলাম, দেখিও যেন ইহা বাতাসে উড়িয়া না যায়। ১৮৬০ সালে কোচবিহারের মহারাজার কাছে মধুসূদনের চাকরির দরখাস্তে এই কথাগ...



... একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পাঠাইলাম, দেখিও যেন ইহা বাতাসে উড়িয়া না যায়।

১৮৬০ সালে কোচবিহারের মহারাজার কাছে মধুসূদনের চাকরির দরখাস্তে এই কথাগুলি লিখে সুপারিশ করে পাঠিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সত্যিই উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা নবজাগরণের ইতিহাসে মাইকেলের প্রতিভা ও চরিত্র দুই-ই যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো বাঙালির ভাবীকালের সাহিত্য ও জীবনে পথরেখা চিহ্নিত করে দিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। 

   পরিচয় ঃ   
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও নাট্যকার এবং প্রহসন রচয়িতা। মধুসূদন দত্তকে বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব গণ্য করা হয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি হিসেবেও তিনি পরিচিত তাই তাকে বঙ্গ ভারতীর দামাল পুত্র মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলা হয়। যশােহর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে ২৫ শে জানুয়ারি ১৮২৪ সালে মধুসূদনের জন্ম হয় ।মাইকেল মধুসূদনের বাবা রাজনারায়ণ দত্ত একজন অবস্থাপন্ন উকিল ছিলেন । মধুসূদনের মা জাহ্নবীদেবী ছিলেন শিক্ষিতা মহিলা । ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ শে জুন রবিবার বঙ্গ ভারতীর দামাল পুত্র কবি মধুসূদন ভিক্ষুকের মতাে নিঃস্ব অবস্থায় কলকাতার এক হাসপাতালে পরলােক গমন করেন ।

    রচনাসমূহ :   
    প্রথম রচনা :   
(a) ইংরাজি রচনা - 'A Vision Captive Ladie' (১৮৪৮-৪৯) ।
(b) বাংলা রচনা - ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ (১৮৬০) ।

   কাব্যগ্রন্থ :     
  • ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য (১৮৬০),
  •  'মেঘনাদ বধ কাব্য' (১৮৬১) 
  • 'ব্রজাঙ্গনা' কাব্য (১৮৬১), 
  • 'বীরাঙ্গনা' কাব্য (১৮৬২), 
  • চতুর্দশপদী কবিতা (১৮৬৬)।
  • ‘হেক্টরবধ’ (১৮৭১) ।

   আলোচনা :  
   (১) 'A Vision Captive Ladie' :   
  •  ১৮৪৮-৪৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাদ্রাজ থেকে ‘Madras Circulator' পত্রিকায় তিনি 'Timothy Penpoem' ছদ্মনামে 'A Vision Captive Ladie' শীর্ষক ইংরেজি কাব্যে পৃথ্বীরাজ সংযুক্তার কাহিনি বর্ণনা করেন। 
  • এটি ১৮৪৯ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

  (২) ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য :  
  • মধুসূদনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ ।
  • কাব্যটি ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। 
  • মাইকেলের উদ্ভাবিত নূতন অমিত্রছন্দে এই কাব্য রচিত। 
  • এই কাব্যের প্রথম দুই সর্গ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
  • যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের প্রেরণায় এই কাব্য সৃষ্টি বলে তাকেই এই গ্রন্থ উৎসর্গ করেন।
  • সংস্কৃত পুরাণ ও মহাভারতের আদি পর্বের কাহিনি অবলম্বনে চার সর্গে মধুসূদন ‘“তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ রচনা করেন।

  (৩) ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য :  
  •  মধুসূদনের অমর সৃষ্টি ‘মেঘনাদবধ কাব্য”। 
  • এই কাব্যের প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন ১৮৬১ সালের জানুয়ারী মাসে। 
  • এই প্রথম খণ্ডে ছিল প্রথম থেকে পঞ্চম সর্গ। 
  • দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ঐ বছরই জুন মাসে, ষষ্ঠ থেকে নবম সর্গ এই খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। 
  • হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় দুখণ্ড একত্রে সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে। এ
  •  এই মহাকাব্য তাঁর আত্ম-আবিষ্কারের কাব্য—আত্মার কাহিনি।
  • ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বাংলা মহাকাব্যধারার প্রথম ও প্রধান সৃষ্টি। 
  • এই কাব্যের কাহিনির ঘটনাকাল তিন দিন দু'রাত্রি মাত্র। 
  • এই কাব্যের নয়টি খন্ড হল যথাক্রমে ---
  1. ‘অভিষেক’
  2. ‘অস্ত্রালাভ’
  3. ‘সমাগম’
  4. ‘অশোকবন’
  5. ‘উদ্যোগ’
  6. ‘বধ’
  7. ‘শক্তিনির্ভেদ’
  8. ‘প্রেতপুরী’
  9. ‘সংস্ক্রিয়া’ ।

  (৪) ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য :  
  •  মধুসূদনের ‘ব্রজাঙ্গনা' কাব্য প্রকাশিত হয় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে।
  • ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনার আগে (১৮৬০) তিনি এই কাব্য রচনা করেছিলেন। 
  • প্রথমে কাব্যটির নাম ছিল ‘রাধাবিরহ’। 
  • ‘রাধাবিরহ’ 'ব্রজাঙ্গনা' কাব্যের প্রথম সর্গ । 
  • রাধাকৃষ্ণ সংক্রান্ত কাহিনি অবলম্বনে ইটালির ‘লিরিক্যাল ওডে’র অনুসরণে মধুসূদন— ‘ব্রজাঙ্গনা' কাব্য রচনা করেন। 
  • কাব্যটির শিরোদেশে মধুসূদন ‘পদাঙ্কদূত’ নামক দূতকাব্য থেকে শ্লোকাংশ উদ্ধৃত করেছেন ।

  (৫) ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য :  
  •  মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা' কাব্য প্রকাশিত হয় ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে।
  • এটি ‘বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রকাব্য’ ।
  • ওভিদের ‘হিরোইডস’ অবলম্বনে এই কাব্য রচিত । 
  •  কাব্যটিতে ১১টি পত্র রয়েছে’।  পত্রগুলি হল যথাক্রমে --- 
  1. দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা, 
  2. সোমের প্রতি তারা, 
  3. দ্বারকনাথের প্রতি রুক্মিণী, 
  4. দশরথের প্রতি কৈকয়ী, 
  5. লক্ষ্মণের প্রতি সূপর্ণখা, 
  6. প্রতি দ্রৌপদী, 
  7. দুর্যোধনের প্রতি ভানুমতী, 
  8. প্রতি দুঃশলা,
  9.  শান্তনুর প্রতি জাহ্নবী, 
  10. পুরুবার প্রতি উর্বশী, 
  11. নীলধ্বজের প্রতি জনা ।

  (৬) ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’:    
  •  মধুসূদনের প্রবাস জীবনের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম ‘চতুর্দশপদী কবিতা’ রচনা! 
  • বাংলা ভাষায় চতুর্দশপদী কবিতার প্রথম জন্ম ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে মধুসূদনের হাতে। 
  • মধুসূদনের সনেটগুলির জন্ম ১৮৬৫তে, কিন্তু তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে। 
  • মধুসূদনের শেষ কাব্য ।
  • চতুদর্শপদী কবিতাবলী' বাংলা সাহিত্যের প্রথম সনেটগুচ্ছ।
  • 'পেত্রার্কের অনুসরণে সনেট লিখতে প্রবৃত্ত হলেও কবি সর্বত্র পেত্রাকের সনেট আঙ্গিকে স্থির থাকেননি, মিলটনের প্রভাবও তাঁর লেখায় দেখা গিয়েছে।

  (৭) ‘হেক্টর বধ’:    
  •  মধুসূদনের জীবনের শেষপর্বে ১৮৭১ সালে তিনি ‘হেকটরবধ’ নামে একটি গদ্য আখ্যান প্রকাশ করেন। 
  • ইলিয়াডের কাহিনিই এই কাব্যের মূল বিষয়। 
  • বাংলা গদ্যে নামধাতুর অজস্র ব্যবহার এই কাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। 
  • এই কাব্যে কবি প্রতিভার তেমন কোন বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে না।


    ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ মধুসূদনের মৌলিক প্রতিভার পরিচয় :   
        বিষয়বস্তু এবং কাব্যকলা—উভয় দিক থেকেই ‘মেঘনাদবধ কাব্য' আধুনিক শিক্ষাবোধসম্পন্ন কবির মৌলিক প্রতিভার পরিচয় দেয়। নতুন ছন্দ ও রূপান্তরিত ভাষার প্রয়োগে, সুপরিকল্পিতভাবে কাহিনি বিন্যাসে, সংহত কাব্যকায়া নির্মাণের দক্ষতাতে মধুসূদন এই কাব্যে আধুনিক কবিদের সামনে কবিতার শিল্পরূপ সৃষ্টির দায়িত্ব সম্পর্কে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। 
  
   কাব্যসাহিত্যে মধুসূদন দত্তের অবদান:   
        মধুসূদনের কবিজীবনের ব্যাপ্তি খুব বেশি নয়। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত কবিজীবনে মাত্র কয়েকটি কাব্যগ্রন্থে তিনি বাংলা কবিতায় আবহমান ধারায় মৌলিক রূপাস্তর সাধন করে গেছেন। তিনিই বাংলা কবিতার বিশ্বকাব্যলোকের উন্নততর আদর্শ ও রুচির প্রবর্তন করেন। তাঁর থেকেই বাংলা কাব্যের আধুনিক যুগের সূচনা।

   ইতিহাসের বিচারে কবি মধুসূদনের বিচার :   
         মধুসূদন বাংলা কাব্যে নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি করেছেন। যুগসন্ধির কবি ঈশ্বর গুপ্ত বা রজালালের তুলনায় কবি ক্ষমতার দিক থেকেই তিনি যে কেবল বহুগুণে বড়ো ছিলেন তা নয়, কাব্য ইতিহাসে নতুন ধারা সৃষ্টি করে ভবিষ্যতের পথ আলোকিত করার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন দ্বিধাহীন।

   বাংলা কাব্যসাহিত্যে মধুসূদনের সৃষ্টিগুলির বিবরণ :   
        বাংলা সাহিত্যের নবজন্ম মধুসূদন থেকে। ইউরোপীয় কাব্য সাহিত্যের প্রভাব তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। ‘তিলোত্তমাসম্ভবের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তনায়। 'ব্রজাঙ্গনা'য় ছন্দের কারুকার্য লক্ষণীয়। 'মেঘনাদবধ' তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। বাংলা ভাষায় একমাত্র এই কাব্যেই মহাকাব্যের গভীর গম্ভীর রস প্রকাশিত । চরিত্র কল্পনায়, জীবনরহস্যের সন্ধানে, বিদ্রোহী মানবভাবনায় এই কাব্য অতি উচ্চস্তরের সৃষ্টি। 'বীরাঙ্গনা' কাব্যে পৌরাণিক নারী চরিত্রে আধুনিক প্রেমমুক্তি-চিত্তমুক্তির সুর। 'চতুর্দশপদী কবিতাবলীতে কবির ব্যক্তিগত প্রীতি, কামনা ও বেদনার প্রকাশ। এটিই সনেটের প্রথম বই।

   বাংলা কাব্যে নবযুগের স্রষ্টারূপে মধুসূদনের মূল্যায়ন :   
         আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম পর্বে মধুসূদনের মতো প্রতিভার উদয় হয়েছিল বলেই পরবর্তীকালের বাংলা কাব্যের এত দ্রুত উন্নতি ও পরিবর্তন হয়েছিল। কাব্যের বাক্রীতিকে তিনিই সর্বপ্রথম পরিচ্ছন্নতা ও সুগমতা দিয়েছিলেন। আধুনিক বাংলা কাব্যের বাকরীতিতে যে পরীক্ষানিরীক্ষা বৈচিত্র্য তার আদি পুরোহিত মধুসূদন—নিঃসন্দেহে।

   ‘আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যে মধুসূদনই একমাত্র মহাকবি কিন্তু তাঁর হৃদয়ের অন্তরালে গীতিকবিতার রসই প্রবাহিত ছিল’–একথা বলার কারণ :   
        মহাকবি মধুসূদন মনে করতেন গীতিকবিতাতেই তাঁর আত্মার মুক্তি। অবশ্য তাঁর মহাকাব্য এবং অন্য কাব্যের মধ্যেও গীতিরসের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর 'আত্মবিলাপ' (১৮৬২) কবিতা এবং ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ (১৮৬২) গানে বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম আধুনিক লিরিক কবিতার বৈশিষ্ট্য সূচিত হয়েছে। যুগের দাবিতে তিনি মহাকবি হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর যথার্থ প্রবণতা ছিল গীতিকবিতার দিকে।            
                                                                                                                
   মধুসূদনের কবি কৃতিত্ব :   
(ক) বাংলা কাব্যজগতে মধুসূদন বিভিন্ন রীতির প্রবর্তক এবং পরবর্তীকালের সাহিত্যিকদের উপর তিনি তাঁর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন। 
(খ) ব্যক্তিগত জীবনে যন্ত্রণা পেলেও তার কাব্য হয়ে উঠেছে সৃষ্টিধর্মী। নিজের জীবনের ব্যথা-বেদনা কাব্যসৃষ্টির অন্তরালে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। 
(গ) নবজাগরণের পুরোহিত মধুসূদন বাংলা কাব্যে সচেতনভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আঙ্গিকের সমন্বয় সাধন করেছেন। যার দ্বারা বাংলা কাব্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল এবং বাংলা কাব্যে যথার্থ আধুনিকতার সঞ্চার হয়েছিল। 
(ঘ) বাংলা কাব্যে প্রথম সাহিত্যিক মহাকাব্য, পত্রকাব্য ও সনেট রচনার কৃতিত্ব মধুসূদনের প্রাপ্য । 

1 comment