বাংলা কবিতায় বিহারীলালের ধারার শ্রেষ্ঠ অনুকারী অক্ষয়কুমার বড়াল। বিহারীলালের বিস্রস্ত অরূপ সৌন্দর্যের পিপাসা অক্ষয়কুমারের কাব্যে রূপ-সংসক...
বাংলা কবিতায় বিহারীলালের ধারার শ্রেষ্ঠ অনুকারী অক্ষয়কুমার বড়াল। বিহারীলালের বিস্রস্ত অরূপ সৌন্দর্যের পিপাসা অক্ষয়কুমারের কাব্যে রূপ-সংসক্ত হয়েছে, কিন্তু আবেগ শুষ্ক হয়ে পড়েনি। তার ভাবনার অন্তরঙ্গে কিশোর রবীন্দ্রনাথের প্রভাবও আছে। আবার নারীর গার্হস্থ্য সৌন্দর্যের পিপাসায় তিনি দেবেন্দ্রনাথের সমধর্মী।
‘প্রকৃতি, সৌন্দর্য ও প্রেম এই ত্রিতন্ত্রীতে তাঁর কাব্যবীণা সুরময় হয়েছিল। নিসর্গের বিষণ্ণমাধুরী, বর্ষার ধারাস্নাত অলস অপরাহ্ন ইত্যাদির বর্ণনায় তিনি রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা প্রস্তুত করেছিলেন।'
(অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত)
পরিচিতি :
অক্ষয়কুমার বড়াল ১৮৬০ সালে র কলকাতার চোরবাগান এলাকার এক স্বর্ণব্যবসায়ীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কালীচরণ বড়াল৷ তাঁদের আদিবাস হুগলী জেলার চন্দননগর৷ তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কলকাতার হেয়ার স্কুলে। কিন্তু পড়াশোনায় তিনি ভালো ছিলেন না। স্কুল শিক্ষা তিনি শেষ করতে পারেননি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর না এগোলেও আমৃত্যু তিনি জ্ঞান আহরণের চেষ্টায় ব্রতী ছিলেন। এ হিসেবে তিনি একজন স্বশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। স্কুল ত্যাগের পর অক্ষয়কুমার দিল্লি অ্যান্ড লন্ডন ব্যাংকের হিসাব বিভাগের কর্মচারী হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯১৯ সালের ১৯ জুন তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
রচনাসমূহ :
প্রথম রচনা : - অক্ষয়কুমার বড়ালের প্রথম কবিতা ‘রজনীর মৃত্যু’ ( কবিতাটি বঙ্গদর্শন পত্রিকার ১২৮৯ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়),
- প্রথম গ্রন্থ - ‘প্রদীপ’ (১৮৮৪) ।
স্বরচিত গ্রন্থ:
অক্ষয়কুমার বড়াল রচিত উল্লেখযোগ্য কাব্য গ্রন্থ হল—
- ‘প্রদীপ' (১৮৮৪),
- 'কনকাঞ্জলি' (১৮৮৫),
- 'ভুল' (১৮৮৭),
- 'শঙ্খ' (১৯১০),
- 'এষা' (১৯১২),
- চণ্ডীদাস (১৯১৭)
সম্পাদিত গ্রন্থ:
- ‘রাজকৃষ্ণ রায়ের কবিতা; (১৮৮৭),
- ‘গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর অশ্রুমালা’ (১৮৮৭)
আলোচনা :
‘এষা’ :
- 'এষা' বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ শোক কাব্য।
- কাব্যটি ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
- মৃতা স্ত্রীর স্মৃতিচারণ করে এষা কাব্যগ্রন্থটি লিখেছিলেন।
বিহারীলালের ভাবশিষ্য :
অক্ষয়কুমার বড়াল হেয়ার স্কুলে পড়ার সময় বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতার প্রতি গভীর ভাবে আকৃষ্ট হন। তার অনুপ্রেরণায়ই তিনি কবিতা রচনা শুরু করেছিলেন। ভাব, ভাষা, ছন্দকে অনুকরণ করে কবিতা রচনা করায় তাকে "বিহারীলালের সাক্ষাৎ ভাবশিষ্য" নামে আখ্যায়িত করা হয়।
অক্ষয়কুমারের কাব্যের বৈশিষ্ট :
(ক) তাঁর কাব্যের প্রেরণা হল নারী - প্রেম । নারী প্রেমের রোমান্টিক ভাব-ভাবনা লক্ষ্য করা যায় ।
(খ) কবিতায় ভাব উচ্ছ্বাস অপেক্ষা ভাষার সংযম বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।
(গ) কবির প্রেম বিরহের চিত্রকল্প সাধারণ আট পৌরে ভাবভঙ্গিকে বিষয় করে বিকশিত হয়েছে।
(ঘ) অক্ষয়কুমারের কাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল হৃদয়াবেগের সংযম। এই সংযম ভাবাবেগের তীব্রতাকে বাস্তব রূপ দিয়েছে।
(ঙ) কাব্যকলায় ব্রাউনিং-এর প্রভাব রয়েছে।
(চ) সুকুমার সেনের মতে,
“অক্ষয় কুমারের ভাষা সংযত ও পরিমিত। বাকসংযম, শব্দচয়ন এবং পদলালিত্যের সঙ্গে ভাবগাম্ভীর্যের মিলন - ইহার রচনারীতির বিশেষত্ব ...... ।”
অক্ষয় কুমার বাংলা গীতিকবিতার ইতিহাসে ‘বড়াল কবি’ নামে পরিচিত। তিনি বিজ্ঞানমনস্ক এবং মার্জিত চিন্তাধারার অনুসারী ছিলেন। তার কাব্য রচনার মূল বিষয় ছিল - শোক , নিসর্গ, কল্পনামূলক প্রেম, সৌন্দর্যবাদ এবং মানববন্দনা। নারীপ্রেমের শান্তরস তাঁর কাব্যের প্রধান বিশেষত্ব।
No comments