চৈতন্যোত্তর যুগের (সপ্তদশ শতাব্দীতে) পশ্চিমবঙ্গের মনসামঙ্গল কাব্যধারার একজন শ্রেষ্ঠ কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ। তার মনসামঙ্গল সর্বপ্রথম মুদ্র...
চৈতন্যোত্তর যুগের (সপ্তদশ শতাব্দীতে) পশ্চিমবঙ্গের মনসামঙ্গল কাব্যধারার একজন শ্রেষ্ঠ কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ। তার মনসামঙ্গল সর্বপ্রথম মুদ্রণ সৌভাগ্য লাভ করেছিল। তিনি পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী হলেও সমগ্র বাংলাদেশেই তাঁর পুঁথি প্রচারলাভ করেছিল।
কবির পরিচয়ঃ
কবির আসল নাম ক্ষেমানন্দ। মনসা বা কেতকার দাস বলেই ‘কেতকাদাস’ উপাধি গ্রহণ করেন। মনসার পরমভক্ত বলেই কাব্যের স্থানে স্থানে কেতকাদাসের উল্লেখ আছে। সুতরাং কেতকাদাস ও ক্ষেমানন্দ একই ব্যক্তি।
ব্যক্তি পরিচয়ঃ
ক্ষেমানন্দের ব্যক্তি পরিচয় তাঁর দেওয়া আত্মপরিচয় থেকে জানা যায়। তার নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার অন্তর্গত বলভদ্রের তালুকে দামোদর তীরবর্তী কাদড়া গ্রামে, কায়স্থ বংশে। তাঁর পিতা শঙ্কর মণ্ডল স্থানীয় ফৌজদার বারাখাঁর অধীনে চাকরি করতেন । আত্মপরিচয়ে কায়স্থ বংশের কল্যাণ কামনা করেছেনঃ
‘‘কেতকার বাণী রক্ষ ঠাকুরাণীকায়স্থ যতেক আছে।’’
নামগত সমস্যাঃ
কবির আসল নাম ক্ষেমানন্দ। কেয়া পাতায় দেবী মনসার জন্ম হয়েছিল বলে মনসার অপর নাম কেতকা । কবি মনসা বা কেতকার দাস বলেই ‘কেতকাদাস’ উপাধি গ্রহণ করেন। মনসার পরমভক্ত বলেই কাব্যের স্থানে স্থানে কেতকাদাসের উল্লেখ আছে। সুতরাং কেতকাদাস ও ক্ষেমানন্দ একই ব্যক্তি।
কাব্য পরিচয়ঃ
কেতকাদাস তাঁর কাব্যের নামকরণ করেন ‘জগতীমঙ্গল’ । পূর্ব বঙ্গে কেতকাদাসের কাব্য ‘ক্ষেমানন্দী’ নামে প্রচলিত ছিল । কাব্য রচনার কারণ হিসাবে কেতকাদাস জানান -- দেবী মনসা একদিন সন্ধ্যায় মুচিনীর বেশে দেখা দিয়ে তাকে কাব্য রচনার করার নির্দেশ দেনঃ
“ওরে পুত্র ক্ষেমানন্দ, কবিত্বে কর প্রবন্ধ,আমার মঙ্গল গাই আ বুল।”কাব্য রচনাকালঃ
যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য,অক্ষয় কুমার কয়াল,প্রমুখদের সংগৃহীত কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল পুঁথিতে কাল নির্দেশক যে ছত্রটি পাওয়া যায় তা হল—
‘শূন্য রস বাণ শশী শিয়রে মনসা আসিআদেশিলা রচিতে মঙ্গল"।
--- ছত্রটি বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় শূন্য = ০, রস = ৬, বাণ = ৫, শশী = ১।
শেষের দিক থেকে লিখলে দাঁড়ায় ১৫৬০ শকাব্দ অর্থাৎ ১৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দ।
আনুমানিক সপ্তদশ শতকে কেতকাদাসের কাব্য রচিত হয় বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে । তবে সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগেই বলে মনে করা হয় ।
কাব্য প্রকাশকালঃ
কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের কাব্য প্রথম মুদ্রন সৌভাগ্য লাভ করে । ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচায়ের সম্পাদনায় কেতকাদাসের মনসামঙ্গল প্রথম মুদ্রিত হয় ।
কাব্য বৈশিষ্ট্যঃ
(a) সহৃদয়তা ও সরলতা কেতকাদাসের কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
(b) তাঁর ভাষা স্বচ্ছ-সরল-প্রসাদগুণসম্পন্ন এবং গ্রাম্যতা দোষমুক্ত।
(c) রচনার সর্বত্রই কবি উচ্চতর আদর্শ রক্ষা করতে পেরেছেন ।
(d) শিথিলতা বর্জন করেছেন।
(e) চৈতন্যদেবের প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় ।
(f) রাঢ় বাংলার ভৌগোলিক জীবনের নিপুণ বর্ননা রয়েছে কেতকাদাসের কাব্যে ।
কাব্য ভাষার উৎকর্ষতাঃ
কেতকাদাসের রচনার ভাষা সুমার্জিত এবং অনুচ্চ গীতরসে পূর্ণ। পাঠকালে যা অতি সহজেই পাঠকদের রুচিবান চিত্তকে আকর্ষণ করে। এ প্রসঙ্গে অবশ্যই উল্লেখ্য বিষয় হল কবির ভাষা প্রয়োগের প্রচেষ্টা কোথাও অতি প্রাকৃত হয়ে ওঠেনি। তাঁর কবিতার চরণে চরণে অনুপ্রাসের ধ্বনি-সাম্যকে মৃদুভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা অতি সহজেই পাঠকের ভ্রমণ বিলাসের কারণ হয়েছে।
কবির ভৌগোলিক জ্ঞান ও তথ্যনিষ্ঠাঃ
কবির ভৌগোলিক জ্ঞান ও ঐতিহাসিক তথ্যনিষ্ঠার পরিচয় মেলে বেহুলার স্বর্গপুরী অভিমুখে যাত্রার মধ্যে। পশ্চিমবাংলার গ্রাম, পথঘাট ও নদনদীর নিপুণ বর্ণনা রয়েছে। কলার মান্দাসে বেহুলা স্বর্গের দিকে ভেসে চলেছেন। সাঁতালি থেকে স্বর্গ পর্যন্ত বেহুলার যাত্রাপথে কবি দামোদর ও তার শাখা নদীগুলির নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন। বাইশটি ঘাটের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার মধ্যে চোদ্দটি ঘাট এখনও বর্তমান। চাঁদ সদাগরের বাণিজ্যপথের বর্ণনায় কবি বাস্তব ভৌগোলিক তথ্য ও পরিবেশ তুলে ধরেছেন।
এক নজরে |
1. কেতকাদাস পশ্চিমবঙ্গের কবি ।
2. কেতকাদাস সপ্তদশ শতকের কবি । 3. কেতকাদাসের প্রকৃত নাম ক্ষেমানন্দ ।
4. কেয়াপাতায় মনসার জন্ম বলে মনসার অপর নাম কেতকা - কবি তাঁরই দাস ,তাই কবি এইরূপ উপাধি গ্রহন করেছেন ।
5. কেতকাদাসের পিতার নাম শঙ্কর মন্ডল ।
6. ক্ষেমানন্দের দেওয়া আত্মপরিচয় থেকে জানা যায় বর্ধমান জেলার অন্তর্গত বলভদ্রের তালুকে দামোদর তীরবর্তী কাঁদরা গ্রামে কায়স্থ বংশে কবি জন্মগ্রহন করেন ।
7. পূর্ববঙ্গে কেতকাদাসের কাব্য ‘ক্ষেমানন্দী’ নামে পরিচিত ।
8. সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কবির কাব্য রচিত হয়েছিল।
9. কেতকাদাস তাঁর কাব্যের নামকরণ করেন ‘জগতীমঙ্গল’ ।
10. কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের কাব্যে চৈতন্য বন্দনা আছে ।
11. কেতকাদাসের কাব্যের 5টি পালা ।
12. কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের কাব্য প্রথম মুদ্রন সৌভাগ্য লাভ করে ।
13. ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচায়ের সম্পাদনায় কেতকাদাসের মনসামঙ্গল প্রথম মুদ্রিত হয়।
14. মনুষ্যতের জীবের মধ্যে মনুষ্যত্বের চেতনা আরোপিত হয়েছে কেতকাদাসের কাব্যে ।
15. কেতকাদাস বলেছেন মনসার জন্ম কেয়া / পদ্মপাতা থেকে ।
16. কেতকাদাসের কাব্যে বেহুলার ভাসান পথে ২২টি ঘাটের কথা আছে ।
17. কেতকাদাসের কাব্যে মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘অভয়ামঙ্গল’ কাব্যের প্রভাব আছে ।
18. ইতিহাস নিষ্ঠার সাথে ভৌগোলিক জ্ঞানের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায় কেতকাদাসের কাব্যে ।
19. অন্যান্য মঙ্গল কবিদের মত কেতকাদাস তাঁর কাব্যে দেবীর স্বপ্নাদেশের কথা উল্লেখ করেন নি ।
20. মুচিনীর বেশ নিয়ে মনসা কেতকাদাসকে কাব্য রচনার নির্দেশ দেন ।
21. মানভূম থেকে দেবনগরী হরফে লেখা ক্ষেমানন্দের ভনিতায় আঞ্চলিক শব্দে পূর্ন একখানি অতি ক্ষুদ্র মনসামঙ্গল পাওয়া যায় । তবে এটা কেতকাদাসের কিনা এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে ।
22. কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের কাব্যে ‘আত্মকাহিনী’ শকবর্ননা নামে পরিচিত ।
23. কেতকাদাস জমিদার ভারমল্লের আশ্রয়ে থেকে কাব্য রচনা করেন ।
দারুন স্যার
ReplyDelete