Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

যতীন্দ্রনাথ রবীন্দ্র যুগের প্রথম বিদ্রোহী কবিঃ

রবীন্দ্র যুগের কবি হয়েও রবীন্দ্রনাথের প্রভাব এড়িয়ে যে কয়জন কবি-সাহিত্যিক নতুন ভাবনা ও স্বতন্ত্র বক্তব্য নিয়ে কাব্যচর্চা করেন, যতীন্দ্রন...



রবীন্দ্র যুগের কবি হয়েও রবীন্দ্রনাথের প্রভাব এড়িয়ে যে কয়জন কবি-সাহিত্যিক নতুন ভাবনা ও স্বতন্ত্র বক্তব্য নিয়ে কাব্যচর্চা করেন, যতীন্দ্রনাথ তাঁদের অন্যতম। তিনি রোমান্টিকতার বিলাসকুঞ্জ থেকে কবিতাকে  নিয়ে এলেন দুঃখদীর্ণ বাস্তবের প্রাত্যহিক আবর্তের মাঝখানে। রবীন্দ্রনাথের ‘অবিরল অতীন্দ্রিয়তার পরে’ যতীন্দ্রনাথের একটা বিদ্রোহ তাঁকে কাব্যজগতে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।  “কাব্যের বহু প্রচলিত আদর্শবাদ ও সৌন্দর্যবোধকে তিনি সাধারণ জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার মানদণ্ডে তীক্ষ্ণ শ্লেষ ও নিপুণ যুক্তি শৃঙ্খলার সাহায্যে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করিয়াছেন। 

পরিচিতিঃ
        ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ শে জুন বর্ধমান জেলার পাতিল পাড়া গ্রামে মাতুলালয়ে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত জন্মগ্রহন করেন ।  পিতা  দ্বারকানাথ সেনগুপ্ত। কবির পৈতৃক নিবাস  নদীয়া জেলার শান্তিপুরের নিকটবর্তী হরিপুর গ্রাম। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের সার্ভেয়রের কাজে যোগ দেন । এরপর ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নদীয়ার কৃষ্ণনগর ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের অধীনে ওভারসিয়ারের কাজে যোগ দেন । কৃষ্ণনগরে কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সাথে কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর পরিচয় ঘটে এবং তিনিই কবিকে কবিতা লেখায় অনুপ্রাণিত করেন। ১৭ ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।

ছদ্মনাম :  শ্রী বিপ্রতীপ গুপ্ত।

কবি সম্পর্কে তথ্যঃ
(a)  যতীন্দ্রনাথ রবীন্দ্র যুগের প্রথম বিদ্রোহী কবি (“কচিডাবের কবি” প্রবন্ধে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এটি বলেছেন)।
(b) তিনি ‘দুঃখবাদী কবি’ নামেও পরিচিত।
(c) তিনিই বাংলা সাহিত্যের প্রথম ‘ইঞ্জিনীয়ার কবি’ ।

প্রথম রচনাঃ
(a)  যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর প্রথম কবিতা ‘শীত’ ১৩১৭ বঙ্গাব্দে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
(b) যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও জীবনে প্রথম লেখেন গদ্যরচনা “প্রত্নমূলক গবেষণা” ।
(c) ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে ৩৬ বছর বয়সে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ “মরীচিকা” প্রকাশিত হয়।


যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত রচিত কাব্যগ্রন্থ :
        যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত মোট সাতটি কাব্যগ্রন্থ লেখেন । কাব্যগ্রন্থগুলি হল ---
১. `মরীচিকা' (১৯২৩) 
 ২. `মরুশিখা' (১৯২৭) 
 ৩. `মরুমায়া' (১৯৩০)
৪. `সায়ম' (১৯৪০)
 ৫. `অনুপূর্বা' (১৯৪৬)
 ৬. `ত্রিযামা' (১৯৪৮)
৭. `নিশান্তিকা' (১৯৫৭)

অনুবাদমূলক গ্রন্থ :
১. ‘কুমারসম্ভব’
 ২. ‘প্রাচীন মেয়ে ’
 ৩. ‘রথী ও সারথী’
৪. ‘ম্যাকবেথ’
 ৫. ‘ওথেলো ’
 ৬. ‘হ্যামলেট’

কাব্য সমালোচনামূলক গ্রন্থ :   ‘কাব্যপরিমিতি’ (১৯৩১)

পাশ্চাত্যের হার্ডি বলার কারণঃ
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের সাথে পাশ্চাত্য কবি ও ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডির সাদৃশ্য রয়েছে । 
            টমাস হার্ডি যেমন মধ্য ভিক্টোরীয় যুগের নির্লিপ্ততা ও প্রশান্তি থেকে যুদ্ধোত্তর বাস্তব চেতনার দিকে ইশারা করেছেন, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও সেই রকম রবীন্দ্র কাব্যের স্বপ্নলুতা থেকে সাম্প্রতিক বাস্তবতায় উত্তরণের স্বাভাবিক হেতু নির্মাণ করেছেন ।

যতীন্দ্রনাথের দুঃখবাদের স্বরূপঃ
        যতীন্দ্রনাথের সর্ব-নশ্বরতার ধারণা এবং তার সঙ্গে সম্পৃক্ত জীবনতৃষ্ণা একান্তই প্রত্যক্ষ ও স্পষ্ট সত্য—জ্ঞানবুদ্ধির আয়ত্তগম্য বিষয়। এখান থেকেই জন্ম নিয়েছে তাঁর দুঃখবাদ। তাঁর দুঃখবাদের মূলে কোনো দুর্ত্তেয়তার চেতনা নেই। দুর্ত্তেয়তা, অসীমাভিমুখী রহস্যদ্যোতনা, ইন্দ্ৰিয়াতীত সূক্ষ্মতা, প্রকৃতি প্রীতি যতীন্দ্রনাথকে আকর্ষণ করতে পারেনি। পারেনি বলেই তিনি জড়বাদী, দুঃখবাদী, রোমান্টিকতা-বিরোধী।


বাংলা কাব্যসাহিত্যে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের স্বাতন্ত্র্যঃ
        কবি যতীন্দ্রনাথ রবীন্দ্র যুগে একটা বিশিষ্ট শাখাপথ সৃষ্টি করে কাব্যসাহিত্যে আপন মহিমায় স্বতন্ত্র স্থান অধিকার করে নিয়েছেন। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার-কবি বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ ও নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রবুদ্ধ হয়ে রবীন্দ্রপ্রভাবের সাবেকি সংস্কারকে ভেঙে দিয়েছেন। প্রেম-প্রকৃতি, ভগবান, রোমান্টিকতা প্রভৃতি কৃত্রিম সংস্কারের চশমা খুলে ফেলে নির্ভেজাল, আবেগবর্জিত, কঠিন বাস্তবের দৃষ্টি দিয়ে জগৎ ও জীবনের অন্তরালবর্তী কঙ্কালমূর্তিকে ফুটিয়ে তোলাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল।

যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কাব্যবৈশিষ্ট্যঃ
        যতীন্দ্রনাথের কাব্যে রবীন্দ্রকল্পনার সচেতন বিরোধিতা দেখা যায়। তাঁর কাব্যে দুঃখবাদী ভাবধারা প্রকাশ পেয়েছে। শেষের দিকের কবিতায় কিছুটা সুরের পরিবর্তন দেখা যায়৷

আধুনিক বাংলা কাব্যসাহিত্যে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের অবদান :
         আধুনিক বাংলা কাব্যসাহিত্যে 'অ্যান্টি-রোমান্টিক', নৈরাশ্যবাদী, বুদ্ধিকেন্দ্রিক বিচিত্র কবিতা লিখে যতীন্দ্রনাথ চিন্তাশীল ও শিক্ষিত মহলে বেশ আলোড়ন তুলেছিলেন। আলোড়নের কারণ শুধু বিষয়বৈচিত্র্য নয়, দুঃখবাদ ও নৈরাশ্যের পীড়নেও। বিষয়বস্তুতে তিনি যেমন শুষ্ক বুদ্ধিবাদী বাস্তব ব্যাপারের আমদানি করলেন, তেমনি রচনাভঙ্গিতে মোটামুটি সনাতন রীতি অনুসরণ করলেও চলতি, অমসৃণ, রূঢ় ধরনের শব্দ ব্যবহারে কিছুমাত্র কার্পণ্য করলেন না। 

যতীন্দ্রনাথের অভিনবত্বঃ
             আবেগপ্রবণ বাংলাকাব্যে বুদ্ধিকেন্দ্রিক, যুক্তিপূর্ণ ও চিরাচরিত আবেগবর্জিত যতীন্দ্রনাথের কাব্যকবিতা পাঠকচিত্তে প্রবল চমক সৃষ্টি করেছিল। কাব্যের পোশাকি সংস্কার ত্যাগ ও প্রকাশের রীতিকে একেবারে কঠোর জীবনরসের দ্বারা সিক্ত করে নিলেন।

যতীন্দ্রনাথ কি দুঃখবাদী ?
        কাব্য-সমালোচকগণ যতীন্দ্রনাথের অভিনব মতবাদ 'দুঃখবাদ'কে খুব একটা মৌলিক বলে মনে করেন না। কাব্যচর্চার গোড়ার দিকে তিনি দুঃখবাদী ও অসংহত নৈরাশ্যবাদী হলেও তিনি নিরীশ্বরবাদী নন। তাঁর ঈশ্বর এক নির্মম শক্তি। তিনি কবির বন্ধু, কিন্তু বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর প্রেমপ্রীতির সম্পর্ক নয়, আঘাতের সম্পর্ক। কবি যত আঘাত পান, ততই নিবিড়তায় দুঃখের দেবতাকে আঁকড়ে ধরতে চান। এই আসক্তির আকর্ষণ থেকেই কবি উত্তরজীবনে দুঃখনৈরাশ্যের জগৎ ছেড়ে প্রেমপ্রীতির আলোকরেখা দেখতে পেলেন, যার আভাস 'সায়ম’, ‘ত্রিযামা’ ও ‘নিশান্তিকা’য় পাওয়া যাবে। 
                    সুতরাং, দুঃখবাদ কবির মুখোশমাত্র।

1 comment

  1. কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের পৈতৃক নিবাস শান্তিপুরের হরিপুর গ্রামে, 'হরিহর' গ্রাম নয়। আর উপরের ছবিতে যতীন্দ্রনাথের বদলে কবি বুদ্ধদেব বসুর ছবি ব্যবহৃত হয়েছে। ভুলগুলো শুধরে নেবেন আশা করি।

    ReplyDelete