Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রঃ

বাংলা নাট্যসাহিত্যে মধুসূদনের পর দীনবন্ধু মিত্রের আবির্ভাব। ‘প্রত্যক্ষ স্বজন প্রেম ও বিদেশী শাসকের প্রজাপীড়নের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অভিযোগ’ এবং ...


বাংলা নাট্যসাহিত্যে মধুসূদনের পর দীনবন্ধু মিত্রের আবির্ভাব। ‘প্রত্যক্ষ স্বজন প্রেম ও বিদেশী শাসকের প্রজাপীড়নের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অভিযোগ’ এবং ‘সর্বব্যাপী সামাজিক অভিজ্ঞতা এবং সর্বব্যাপী সামাজিক সহানুভূতি নিয়ে সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্যেই নাট্যসাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন দীনবন্ধু মিত্র। নাট্যকার হিসাবে তার খ্যাতি মূলত ‘নীলদর্পণ’ নাটকের জন্যই। সমসাময়িক সামাজিক জীবনের উজ্জ্বল আলেখ্য হিসাবে তার নাটকগুলির স্বতন্ত্র মর্যাদা রয়েছে।

পরিচয় ঃ
        নদীয়া জেলার চৌবেড়িয়া গ্রামে ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১লা নভেম্বর দীনবন্ধু মিত্রের জন্ম হয় । দীনবন্ধুর পিতৃদত্ত নাম ছিল ‘গন্ধবনারায়ণ’ । পিতা ছিলেন কালাচাঁদ মিত্র। তিনি ঈশ্বরগুপ্তের ভাবশিষ্য ছিলেন। ঈশ্বরগুপ্তের প্রেরনায় ‘সাধুরঞ্জন’ ও ‘সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকায় কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্য জগতে প্রবেশ ঘটে । মনে করা হয় দীনবন্ধু মিত্রের প্রথম কবিতা ‘মানব চরিত্র’ । কবিতাটি ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত ‘সাধুরঞ্জন’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ।

* দীনবন্ধু মিত্রের নাট্যসমূহ :
সামাজিক নাটক ঃ
(a) ‘নীলদর্পন’ (১৮৬০)


রোমান্টিক নাটক ঃ
(a) ‘নবীন তপস্বিনী’ (১৮৬৩)
(b) ‘লীলাবতী’ (১৮৬৭)
(c)  ‘কমলে কামিনী’ (১৮৭৩)

কমেডি / প্রহসন ঃ
(a)  বিয়ে পাগলা বুড়ো’ (১৮৬৬)
(b)  ‘সধবার একাদশী' (১৮৬৬)
(c)  ‘জামাই বারিক' (১৮৭২)

কবিতাগুচ্ছ  ঃ
(a) ‘সুরধ্বনি কাব্য’ (১৮৭১ - ৭৬) 
(b) ‘দ্বাদশ কবিতা’ (১৮৭২)

গদ্যস্কেচ  ঃ
(a) ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’
(b) ‘পোড়া মহেশ্বর’


আলোচনা ঃ
নীলদর্পন (১৮৬০) ঃ
➤ দীনবন্ধু মিত্রের সামাজিক নাটক ‘নীলদর্পন'।
➤ নাটকটি ঢাকায় বসে রচনা করেন ।
➤ এই নাটকের ঘটনাবলী গৃহীত হয়েছে যশোহর, খুলনা, নদীয়া, চব্বিশ পরগণা জেলা থেকে ।
➤ ঢাকা থেকে ‘নীলকর বিষধর দর্শনকাতর প্রজানিকর ক্ষেমঙ্করেন কেনচিৎ পথিকানাভি প্রনীতম' ছদ্মনামে এই নাটকটি প্রকাশিত হয় ।
➤ এটিই প্রথম বাংলা নাটক, যা বাংলা থেকে ইংরাজিতে অনুদিত হয় ।
➤  মধুসূদন দত্ত ‘A Native' ছদ্মনাম ব্যবহার করে ১৮৬১ সালে নীলদর্পন ইংরাজিতে অনুবাদ করেন । 
➤ ইংরাজি অনুবাদের নাম ছিল 'Nil Darpan or The Indigo Planting Mirror' ।
➤ মাইকেল মধুসূদন দত্ত 'A Native' ছদ্মনামের আসল পরিচয় সামনে আনেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ।
➤  নাটকের ইংরাজি অনুবাদের প্রকাশক ছিলেন পাদরী জেমস লঙ সাহেব ।
➤ নাটকে অনুবাদকের কোনো নাম ছিল না। প্রায় ৫০০ কপি বই প্রকাশ করা হয়।
➤  অনুবাদ প্রকাশের দায়ে প্রকাশক জেমস লঙকে ১ মাসের কারাদন্ড ও ১০০০ টাকা জরিমানা করা হয়। 
➤ জরিমানার টাকা দেন কালিপ্রসন্ন সিংহ ।
➤ বিখ্যাত মার্কিন মহিলা ঔপন্যাসিক হ্যারিয়েট রিচার স্টো’র ‘Uncle Tom's Cabin' এর সাথে তুলনা করা হয় ।
➤ ‘নীলদর্পন’ ট্রাজেডি নয় মেলোড্রামা ।
➤ এই নাটকটি ঢাকার ‘পূর্ববঙ্গ ভূমি’তে প্রথম অভিনীত হয় ।
➤  ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ সেপ্টেম্বর নাটকটি ন্যাশনাল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় ।
➤ এই নাটকের প্রধান চরিত্র - গোলকচন্দ্র, নবীনমাধব, সাবিত্রী, সরলতা, তোরাপ, সাধুচরণ, পদী ময়রাণী।

palas

‘নবীন তপস্বিনী (১৮৬৩) ঃ
➤ ‘নবীন তপস্বিনী’ নাটকটি দীনবন্ধ মিত্র ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্মনগর থেকে প্রকাশ করেন ।
➤ রোমান্টিক নাটক এটি ।
➤ এই নাটকের উৎসর্গ পত্রে নাম ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের।
➤ মনে করা হয় এই নাটকের ‘জলধর’ চরিত্রটি শেক্সপীয়ারের 'Marry Wives of Windsor' এর ফলস্টাফের অনুকরণে রচিত ।
➤ এই নাটকের প্রধান চরিত্র জলধর, বিদ্যাভূষণ, তপস্বিনী, বিজয়, কামিনী ।

‘লীলাবতী (১৮৬৭) ঃ
➤ ‘লীলাবতী’ মিলনান্তক নাটক ।
➤ এই নাটকের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে দীনবন্ধু মিত্র কালিদাসের ‘রঘুবংশম’ থেকে
➤ একটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন ।
➤ এই নাটকের প্রধান চরিত্র নদেরচাঁদ, হেমচাঁদ, লীলাবতী, হরবিলাস ।

‘কমলে কামিনী’(১৮৭৩) ঃ
➤ দীনবন্ধু মিত্রের শেষ নাটক এটি ।
➤ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর বাহাদুরকে এই নাটকটি উৎসর্গ করেন ।
➤ নাটকটিতে মণিপুর, কাছাড় অঞ্চলের বর্নিত হয়েছে ।
➤ ‘সুরবালা’ চরিত্রে বঙ্কিমের ‘দুর্গেশনন্দিনীর’ বিমলা চরিত্রের প্রভাব দেখা যায়।
 এই নাটকের প্রধান চরিত্র কল্যাণী, সুরবালা, শিখন্ডীবাহন ।

‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ (১৮৬৬) ঃ
➤ এটি কমোড নাটক ।
➤ এই নাটক ‘স্যাটয়ারিক কমেডির অন্তর্ভূক্ত । এই কমেডির উদ্ভাবক বেন জনসন ।
➤ এই নাটকটি দুই অঙ্কে সমাপ্ত ।
➤ নাটকটি মধুসুদনের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' প্রহসনের অনুকরণে রচিত । মধুসূদনের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' প্রহসনের ভক্তপ্রসাদের সাথে রাজীবলোচনের চরিত্রের সাদৃশ্য রয়েছে ।
➤ এই নাটকের প্রধান চরিত্র -- রাজীব, রাসমনি, গৌর বন ।

‘সধবার একাদশী’ (১৮৬৬) ঃ
➤ এই নাটকটি সামাজিক কমেডি ।
➤ এই নাটকের প্রধান চরিত্র নিমচাঁদ, ঘরিরাম ডেপুটি, অটল, ভোলা,
➤ মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা'র নবকুমারের সাথে নির্মচাদের সাদৃশ্য রয়েছে বলে মনে করেন ।

‘জামাই বারিক’ (১৮৭২) ঃ
➤ বিশুদ্ধ প্রহসন।
➤ এটি দীনবন্ধু মিত্রের তৃতীয় প্রহসন ।
➤ স্ত্রী প্রধান প্রহসন।


 ট্র্যাজেডি নাটক হিসেবে 'নীলদর্পণ'-এর সার্থকতা ঃ
        ‘নীলদর্পণ' নাটক ট্র্যাজেডি হিসেবে খুব সার্থক হয়নি। এতে তিনি জনসাধারণ ও দুষ্ট চরিত্রাঙ্কনে অসাধারণ বাস্তব জ্ঞানের পরিচয় দিলেও তথাকথিত সৎ ও সাধু প্রকৃতির ভদ্র চরিত্র অঙ্কনে ততটা সার্থক হননি। এদের ব্যবহার, ভাষা ইত্যাদি অত্যক্ত কৃত্রিম হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া ট্র্যাজেডির সূক্ষ্মতা, বেদনার তীব্রতা প্রভৃতির চেয়ে খুনোখুনি, আত্মহত্যা প্রভৃতি স্প্যানিশ ট্র্যাজেডির মতো রক্তারক্তির  বাহ্যিক আড়ম্বরটাই এ নাটকে প্রাধান্য পেয়েছে বেশি।

কমেডি নাটকে দীনবন্ধু মিত্রের প্রতিভা ঃ
            দীনবন্ধুর প্রতিভা মূলত শ্রেষ্ঠ কমেডি লেখকের প্রতিভা। উচ্চশ্রেণির নাট্যধর্মময় কৌতুক ও পরিহাস, জীবনের ক্ষয়ক্ষতির প্রতি নিঃস্পৃহতা, নানা অসংগতির প্রতি প্রথমশ্রেণির হাস্যরসিকের মতো সকৌতুক সহনশীলতা এর দ্বারা তিনি বাংলা নাটকে স্পৃহনীয় স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

প্রহসনের বিষয় ঃ
        প্রহসনধর্মী নাটক ‘বিয়ে পাগল বুড়ো’ (১৮৬৬) প্রহসনে বিবাহবাতিকগ্রস্ত এক বৃদ্ধের নকল বিয়ের আয়োজন করে স্কুলের অকালপরিপক্ব ছেলেরা কীভাবে তাকে নাস্তানাবুদ করেছিল তারই এক কৌতুককর কাহিনি বর্ণিত। ‘সধবার একাদশী’ নাটকের মাধ্যমে তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজের উচ্চশ্রেণীর ব্যক্তি বর্গের চাল-চরিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মদ্যপানের কুফল ফুটিয়ে তোলা এ নাটকের অন্যকম উদ্দেশ্য। মদ্যপানের সঙ্গে সঙ্গে ততকালীন সমাজের বেশ্যাসক্তির বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‘জামাইবারিক’ (১৮৭২) এ ধনী পরিবারের ঘরজামাই পোষার প্রথাকে হাসিঠাটার মধ্য দিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়েছে।

লীলাবতী নাটকের মূলভাব ঃ
        দীনবন্ধু মিত্রের প্রহসনধর্মী নাট্যফসল 'লীলাবতী' (১৮৬৭) সমসাময়িক নাগরিক জীবনের হাস্য পরিহাস ও নায়ক-নায়িকার মিলন-সংক্রান্ত একটি জটিল কাহিনি অবলম্বনে রচিত হয়েছে।

নীলদর্পন নাটককে দলিল বলার কারণ ঃ
       সিপাহি বিদ্রোহের পর নীলকর সাহেবরা গ্রাম্য চাষিদের ওপর নির্মমভাবে অত্যাচার চালাত। ধানের জমিতে জোর করে নীলচাষ করতে বাধ্য করে ইংরেজ ব্যবসায়ীবৃন্দ চাষিদের সারাবছরের ক্ষুধার অন্ন উৎপাদন বন্ধ করত। নীলচাষে অনিচ্ছুক চাষিদের জোর করে আটক রাখা, তাদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, প্রহার এমনকি মহিলাদের প্রতি অত্যাচার করতেও তারা দ্বিধাবোধ করত না। কিন্তু পরে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকেরা সংঘবদ্ধ হয়ে নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে এবং কলকাতার শিক্ষিত সমাজ এই আন্দোলনে সামিল হয়।

দীনবন্ধু মিত্রের শ্রেষ্ঠ প্রহসন ঃ
        ‘সধবার একাদশী' (১৮৬৬) শ্রেষ্ঠ প্রহসন। এই নাটকের নায়ক নিমে দত্ত চরিত্রে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকদের প্রতিচ্ছায়া আছে, কিন্তু তাকে টাইপ চরিত্র বলা যাবে না। বরং বলা যায়, শিক্ষাদীক্ষায় মার্জিত, জীবনের শুভাশুভ বিষয়ে প্রখর চেতনাসম্পন্ন একটি মানুষ প্রবৃত্তির অচ্ছেদ্য বন্ধনের মধ্যে নিজেকে ক্ষয় করছে। এই চরিত্রটির জন্যেই সধবার একাদশী প্রহসনের সীমা অতিক্রম করে গভীর রসাত্মক নাটকে পরিণত হয়েছে। 

দীনবন্ধুর নাট্যসৃষ্টি পাশ্চাত্যের প্রভাবঃ 
            দীনবন্ধুর অবিকল শেকসপিয়রের মতো, অবশ্য সঙ্কীর্ণতর ক্ষেত্রে। সেই বিশুদ্ধ বস্তুগত দৃষ্টি, জীবনের প্রতি প্রসন্নতা, পরিহাস ও বেদনা, ব্যঙ্গ ও করুণার এমন সন্নিবেশ আমরা আর কোনো বাঙালি নাট্যকারের মধ্যে পাইনি। ম্যাথু আরনল্ড, কিটসের কবিদৃষ্টি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘Heis with Shakespeare' সেই কথার প্রতিধ্বনি দীনবন্ধু সম্বন্ধেও বলা যায়।

No comments