Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

নাট্যকার মধুসূদন দত্তঃ

মধুসূদন ছিলেন প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। নাটকের সূত্র ধরেই বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে মহাকবি মধুসূদনের প্রথম আবির্ভাব। মধুসূদনের আবির্ভাবে বাংলা না...



মধুসূদন ছিলেন প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। নাটকের সূত্র ধরেই বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে মহাকবি মধুসূদনের প্রথম আবির্ভাব। মধুসূদনের আবির্ভাবে বাংলা নাটক সংস্কৃত নাটকের প্রভাব থেকে দূরে সরে গেল। মধুসূদনের আবির্ভাবের পূর্বে তখন বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে সংস্কৃত ও ইংরেজি নাটকের অনুবাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চও গড়ে উঠছিল। ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের পাইক পাড়ার জমিদার সিংহদের বাড়িতে বেলগাছিয়া থিয়েটারে রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘রত্নাবলী’ (১৮৫৮) নাটকের অভিনয় দেখে মধুসূদন দত্ত অবাক হয়ে যান । কবি আক্ষেপ করে বলেন -- 
“অলীক কূনাট্যরঙ্গে মজে লোক রাঢ়বঙ্গে / নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয় ।” 
---- বাংলা নাটকের এই দৈন্যদশা দূর করতে তিনি নাট্য রচনায় মনোনিবেশ করেন।

পরিচয় ঃ
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও নাট্যকার এবং প্রহসন রচয়িতা। মধুসূদন দত্তকে বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব গণ্য করা হয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি হিসেবেও তিনি পরিচিত তাই তাকে বঙ্গ ভারতীর দামাল পুত্র মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলা হয়। যশােহর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে ২৫ শে জানুয়ারি ১৮২৪ সালে মধুসূদনের জন্ম হয় ।মাইকেল মধুসূদনের বাবা রাজনারায়ণ দত্ত একজন অবস্থাপন্ন উকিল ছিলেন । মধুসূদনের মা জাহ্নবীদেবী ছিলেন শিক্ষিতা মহিলা । ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ শে জুন রবিবার বঙ্গ ভারতীর দামাল পুত্র কবি মধুসূদন ভিক্ষুকের মতাে নিঃস্ব অবস্থায় আলিপুর , কলকাতার এক হাসপাতালে পরলােক গমন করেন ।

নাট্য পরিচয় ঃ
(a) Rizia (আনুমানিক 1849) 
➤ মধুসূদনের প্রথম ইংরাজি ভাষায় রচিত নাটক --‘Rizia' । 
➤ ‘Rizia : The Empress of India'
➤ এটি একটি ঐতিহাসিক নাটক । 
➤ অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত ।  
➤ মাাদ্রাজে (চেন্নাই) থাকাকালীন কবি এই নাটকটি রচনা করেন ।
➤ নাটকটি ‘ইউরেশিয়ান’ (Eurasian) পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ।  


(b) ‘শর্মিষ্ঠা’ (1859) ঃ
➤ মধুসূদনের প্রথম নাটক – ‘শর্মিষ্ঠা’
➤ পৌরানিক নাটক এটি ।
➤ এই নাটকের মূল উৎস মহাভারতের আদি পর্ব ।
➤ মহাভারতের আদি পর্বের শমিষ্ঠা - যযাতি - দেবযানীর ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী, ঈর্ষা ও কামবৃত্তির কাহিনীই এই নাটকের আলোচ্য বিষয় ।
➤ এই নাটকের প্রধান চরিত্র - শর্মিষ্ঠা, যযাতি, দেবযানী, শুক্রাচার্য, বকাসুর

(c) ‘পদ্মাবতী’ (1860) ঃ
➤ মধূসূদনের দ্বিতীয় নাটক ‘পদ্মাবতী'।
➤ পৌরানিক নাটক এটি ।
➤ নাটকটি কলির সংলাপে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত ।
➤ গ্রীক পুরাণের ‘Apple of Discord' অবলম্বনে রচিত । • এই নাটকের মূল ভিত্তি গ্রীক পুরাণের কাহিনী ।
➤ এই নাটকের কাহিনীতে হেরা, আথেনে এবং আফ্রেদিতে – এই তিন দেবীর মধ্যে একটি সোনার আপেলের অধিকার নিয়ে বিরোধ এবং প্যারিসের মধ্যস্থতায় আফ্রেদিতে জয়লাভ করে । পরবর্তী স্তরে দেবী ত্রয়ের মধ্যে ঈর্ষা ও দ্বন্দ্বের জটিলতা দেখা যায় ।
➤ এই নাটকের প্রধান চরিত্র পদ্মাবতী, রতিদেবী, ইন্দ্রনীল, শচীদেবী, নারদ ।
➤ এই নাটকে ঃ
* শচী ---- গ্রীক পুরাণের ইন্দ্রানী অর্থাৎ জুনো ।
* মুরলা ----  প্যালাস ।
* রতি ---- ভিনাস
* ইন্দ্ৰনীল -- প্যারিস ।
* পদ্মাবতী ---- হেলেন ।

(d) ‘সুভদ্রা’ ঃ
➤ ‘পদ্মাবতী’ নাটক রচনা করার পর তিনি এই নাটক রচনা করনে । 
➤ নাটকটি মধুসূদন শেষ করতে পারেন নি ।
 ➤ মহাভারতের উপাখ্যান নিয়ে নাটকটি রচিত হয়েছিল ।

(e) ‘কৃষ্ণকুমারী’ (1861) ঃ
➤ বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঐতিহাসিক নাটক ।
➤ এটি তাঁর সবশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক ।
➤ এই নাটকের মূল উৎস – কর্নেল টডের ‘Annals and Antiquities of  Rajasthan
➤ ‘কৃষকুমারী’ বিষাদময়, বিয়োগান্তক নাটক । এই নাটকে রাণা ভীমসিংহের অসাধারণ সুন্দরী কন্যা  কৃষকুমারী রাজ্যের কল্যাণে এবং পিতাকে দারুণ বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করেন । মানসিংহ এবং জগৎসিংহ দুজনেই কৃষকুমারীকে বিয়ে করতে চান এবং ব্যর্থ হলে উভয়েই ভীমসিংহের সর্বনাশ করবেন বলে ভয় দেখান । ভীম সিংহ কন্যা স্নেন ও রাজ্যরক্ষার মধ্যে কোনটিকে বেছে নেবেন ঠিক করতে পারলেন না । এমত অবস্থায় আত্মহত্যা করে পদ্মাবতী পিতা এবং পিতৃরাজ্যকে নিশ্চিন্ত করে গেলেন । এ দুর্ঘটনায় ভীমসিংহ উন্মাদ হয়ে যান । 
➤ নাট্যকার মূল কাহিনীর সাথে ধনদাস, মদনিকা ও বিলাসবতীর কাহিনী সংযুক্ত করেছেন ।
➤ এই নাটকের প্রধান চরিত্র -- কুয়কুমারী, ভীমসিংহ, মানসিংহ, ধনদাস, মদনিকা।

(f) ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (1860) ঃ
➤ পাইক পাড়ার বিদ্যুৎসাহী জমিদার সিংহ ভ্রাতাদের অনুরোধে মধুসূদন এই নাটকটি রচনা করেন । 
➤ এটি একটি ‘প্রহসন’।
➤ এই প্রহসনটিতে ইংরাজি শিক্ষিত মদাসক্ত ভ্রস্টাচার ও তরুণ ইয়ংবেঙ্গল যুবকদের কদাচারকে শানিত রঙ্গব্যঙ্গের ভাষায় দারুণ কশাঘাত করা হয়েছে । নাগরিক কলকাতার তরুণ সমাজকে তীব্র ব্যঙ্গ করা হয়েছে ।
➤ এই নাটকের প্রধান চরিত্র - নবকুমার, কালিনাথ, মহেশ, বলাই, প্রসন্ন, হরকামিনী, কমলা ।

(g) ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ (1860) ঃ
➤ পাইক পাড়ার বিদ্যুৎসাহী জমিদার সিংহ ভ্রাতাদের অনুরোধে মধুসূদন এই নাটকটি রচনা করেন ।
➤ ২ অঙ্ক ও ৪ গর্ভাঙ্কে সমাপ্ত হয়েছে নাটকটি ।
➤ এটি একটি “প্রহসন।
➤ এই নাটকের আগের নাম ছিল 'ভগ্ন শিবমন্দির । নাটকটির নামকরণ করেন রাজা ঈশ্বরচন্দ্র।
➤ এই প্রহসনটিতে প্রাচীন ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের কুচরিত্র ও লাম্পট্য খুব রসাল ভাষায় বর্নিত হয়েছে ।
➤ এই নাটকের প্রধান চরিত্র ভক্তসাদ হানিফ ও হানিফের স্ত্রী ফতেমা।


(h) ‘মায়াকানন’ (1874) ঃ
➤ এটি কবির অসমাপ্ত নাটক ।
➤ এটি একটি রূপক নাটক ।
➤ মধুসূদনের মৃত্যুর পর এই নাটকটি ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
➤ ‘মায়াকানন' একটি দুঃখের কাহিনী। এতে অজয় ও ইন্দুমতির প্রেম নিতান্তই কল্পনাচারী। কেবল দর্শন ও এবনেই এই প্রেমের উৎপত্তি ও অধিষ্ঠান। তাই তাদের বিলাপ ও খেদোক্তি অনেকটা কৃত্রিম ও প্রাণহীন মনে হয় ।
➤ এই নাটকের প্রধান চরিত্র ইন্দিরা, অজয়, ইন্দুমতি ।

(i) ‘বিষ না ধনুর্গুন’ ঃ
 ➤ এটি কবির অসমাপ্ত নাটক ।
➤ এটি একটি রূপক নাটক ।

মধূসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা' নাটকটির মূল্যায়নঃ
        মূল আখ্যানের স্বয়ং নায়িকা শর্মিষ্ঠা চরিত্রকে কবি অধিকতর বিশুদ্ধ চরিত্রাদর্শনের দ্বারা নবরূপ দিয়েছেন। তবে বাস্তবতা ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের দিক থেকে দেবযানীর চরিত্র অধিকতর জীবস্ত। কাহিনি ও রচনার কোনো কোনো অংশে কালিদাসের শকুম্ভলার প্রভাব যদিও আছে তবু এর রচনাক্রম ও গ্রন্থনপদ্ধতি পুরোপুরি পাশ্চাত্যপন্থী। তবে অসাধারণ মঞ্চসফল নাটকটির ত্রুটি—এর গতিবেগ আবেগের দ্বারা মন্থর, সংঘাতের চেয়ে বিবৃতি বড়ো, অতিনাটকীয় ও যাত্রার ধরনের বাগাড়ম্বরের ফলে এর নাটকীয় রস বহুস্থলে ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

‘পদ্মাবতী’ নাটকের গুরুত্বঃ
(ক) নাটকটির কাহিনি ও চরিত্রগুলিকে পাশ্চাত্য প্রভাবিত মধুসূদন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ভারতীয় ধরনের করে তুলেছেন।
(খ) নাট্যকার সংস্কৃত নাটকের প্রভাব ছাড়তে পারেননি, তবে ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি ‘শর্মিষ্ঠা'র চেয়ে স্বাভাবিক হয়েছে। 
(গ) এই নাটকে তিনি কলির উক্তিতে কয়েকছত্র অমিত্রাক্ষর প্রয়োগ করে কাব্যে ছন্দগত বিপ্লবের সূচনা করেন।

‘কৃষ্ণকুমারী’  মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ নাটকঃ
        রচনা, গ্রন্থনা, ঘটনা-সংঘাত ও সংলাপের দিক থেকে ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১) নাটক মধুসূদনের নাট্যপ্রতিভার সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয় বহন করছে। বাংলা নাটকের ইতিহাসেও এর স্থান খুব উচ্চে। কবি রানা ভীমসিংহের ট্র্যাজিক ব্যর্থতা ও কৃষ্ণকুমারীর আখ্যানে করুণরসের উচ্ছ্বাস অতিসংযতভাবে বর্ণনা করেছেন। এর সঙ্গে যে উপকাহিনি আছে (অর্থাৎ ধনদাস বিলাসবতীর কাহিনি) তারও প্রয়োগ যৌক্তিকতা প্রশংসনীয়।

প্রহসন দুটির মূলভাবঃ
        ‘একেই কি বলে সভ্যতা' নামক প্রথম প্রহসনে ইংরেজি শিক্ষিতভ্রষ্টাচার তরুণ যুবকদের কদাচারকে শাণিত রঙ্গব্যঙ্গের ভাষায় দারুণ কশাঘাত করা হয়েছে। দ্বিতীয় প্রহসন ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ'তে তথাকথিত প্রাচীন ব্রাহ্মণ সমাজপতির কুচরিত্র ও লাম্পট্য খুব রসালোভাবে বর্ণিত। প্রথমটিতে পুরোপুরি রঙ্গব্যঙ্গে প্রহসন, কাহিনি নামমাত্র দ্বিতীয়টিতে গ্রাম্য বাংলার ধর্মধ্বজী বৃদ্ধের আক্রমণস্থল।

নাটকের উৎপত্তি ও ক্রম বিকাশের ধারায় মধুসূদনের অবদানঃ
        আধুনিক রীতির নাটকের প্রথম পথ নির্মাণ করেন মধুসূদন, তারপর সে পথ ধরে কত নাট্যকার এসেছেন। প্রথম দিকের পেশাদারি রঙ্গমঞগুলো তাঁর এবং দীনবন্ধুর নাটক-প্রহসন নিয়েই আসরে অবতীর্ণ হয়েছিল। মধুসূদনের প্রতিভা মূলত মহাকবি ও গীতিকবির প্রতিভা। তদুপরি নাটকের ক্ষেত্রেও তিনি চমৎকার কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা অস্বীকার করা যায় না। হয়তো খুঁটিয়ে দেখলে তাঁর নাটকেও কিছু কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি চোখে পড়বে, কিন্তু নাটকে, বিশেষ প্রহসনে তাঁর লোকচরিত্রজ্ঞান ও তাদের জীবনচিত্রাঙ্কন আজও প্রশংসনীয়।

No comments