Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

‘ভাষাচার্য’ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় :

বাঙালি মেধা নিয়েই জন্মায়। জীবনে যা সে গ্রহণ করে তা কেবল নিজেকে পরিপুষ্ট করার বিদ্যা। এমনই এক মেধাসম্পন্ন বাঙালি, সমগ্র বাঙালির অহংকার ভাষাতা...


বাঙালি মেধা নিয়েই জন্মায়। জীবনে যা সে গ্রহণ করে তা কেবল নিজেকে পরিপুষ্ট করার বিদ্যা। এমনই এক মেধাসম্পন্ন বাঙালি, সমগ্র বাঙালির অহংকার ভাষাতাত্ত্বিক, সাহিত্যিক এবং শিক্ষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় । আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ‌্যায় একালের প্রবাদপ্রতিম ব‌্যক্তিত্ব। বাংলা তথা ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতি-ভাষাতত্ত্ব ও সমাজজীবনে তাঁর অবদানের প্রসঙ্গ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

পরিচয়ঃ
        সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় একজন ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। তিনি ১৮৯০ সালের ২৬ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার শিবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মতিলাল শীল ফ্রি স্কুল থেকে ১৯০৭ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ৬ষ্ঠ স্থান অধিকার করেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ১৯০৯ সালে ৩য় স্থান অধিকার করে এফ.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১১ সালে ইংরেজিতে সম্মানসহ বি.এ.তে এবং ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম.এ.তে ১ম স্থান অধিকার করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে তিন খণ্ডের দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপম্যান্ট অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ বইটি লিখে অসাধারণ বিদ্যাবত্তার পরিচয় দেন। তিনি ১৯৭৭ সালের ২৯ মে মৃত্যুবরণ করেন।

উপাধি ঃ ‘ভাষাচার্য’ (রবীন্দ্রনাথ এই উপাধি দিয়েছিলেন ) ।

রচনাবলীঃ
আত্মজীবনীঃ জীবনকথা’ (১৯৭৯) -- অসম্পূর্ণ ।
বাংলা গ্রন্থঃ
(১) ‘0. B.D. L’ -( The Origin and Development of the Bengali Language) --  ১৯২৬
(২) ‘বাংলা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা’-১৯২৯
(৩) ‘জাতি সংস্কৃতি ও সাহিত্য'-১৯৩৮
(৪) ‘পশ্চিমের যাত্রী'-১৯৩৮
(৫) ‘ইউরোপ’ -  ১৯৩৮
(৬) "ভাষা প্রকাশ ও বাঙ্গালা ব্যাকরণ’-১৯৩৯
(৭) ‘দ্বীপময় ভারত’ - ১৯৪০
(৮) ‘ভারতের ভাষা ও ভাষা সমস্যা’-১৯88
(৯) ‘ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ - ১৯৪৪
(১০) 'ভারত সংস্কৃতি'-১৯৪৪
(১১) ‘সাংস্কৃতিকী’ - (১ম খন্ড - ১৯৬২, ২য় খন্ড - ১৯৬৫, ৩য় খন্ড - ১৯৭২)
(১২) ‘পথ চলতি’ (১ম খন্ড - ১৯৬২, ২য় খন্ড - ১৯৬৪)
(১৩) ‘বাংলা ভাষা প্রসঙ্গে'-১৯৭৫
(১৪) ‘সংস্কৃতি শিল্প ইতিহাস'-১৯৭৬
(১৫) ‘বাঙালির সংস্কৃতি-১৯৯০

ইংরেজিতে লেখা গ্রন্থ :
(১) "Bengali self taught”-১৯২৭
(২) "A bengali phonetic Reader”-১৯২৮
(৩) ‘‘IndoAryan and Hindi” -১৯৪২
(৪) ‘‘Languages and Literatures of Modern India’’  - ১৯৬৩
(৫) ‘‘World Literature and Tagore’’  - ১৯৭১
(৬) ‘‘On the Development of Middle Indo Aryan”-১৯৮৩

আলোচনা ঃ
(a) ‘The Origin and Development of the Bengali Language :
        বাংলা ভাষার সঙ্গে ভারতীয় আর্যভাষা শাখার অন্য ভাষাগুলোর সংস্পর্শ ও মিথষ্ক্রিয়া ঘটেছে নানা কারণে। এই বিবেচনায় বাংলা ভাষার গতি-প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করতে গিয়ে অন্য ভাষাগুলোর পরিচয় দিয়েছেন সুনীতিকুমার। উত্তর-পশ্চিম ভারতের দার্দিক ভাষা উল্লিখিত ভাষা-শাখার অন্তর্গত না হলেও এই ভাষার আলোচনাও করেছেন তিনি। পশ্চিম পাঞ্জাবি বা লাহন্দি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, রাজস্থানি শাখার মারওয়ারি, জয়পুরি, মেওয়াতি, পাহাড়ি বা খাশা, খাসকুরা, পশ্চিমি হিন্দি এবং এর বিভিন্ন রূপ, পূর্বীয় হিন্দি, মারাঠি, ভোজপুরিয়া, সিংহলি এবং পশ্চিম এশিয়ার জিপসিদের ভাষার পরিচয় আছে The Origin and Development of the Bengali Language-এ।

(b) ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ :
        ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণে সুনীতিকুমার বাংলা ব্যাকরণের একটি আদর্শ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পরে বিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপযোগী এই ব্যাকরণের একটি সরল সংস্করণও তিনি রচনা করেছেন সরল ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ নামে। ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্বের আলোচনায় সুনীতিকুমারের এই ব্যাকরণ বাংলা ব্যাকরণচর্চার ইতিহাসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস। বাংলা ব্যাকরণের আলোচনায় বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের প্রয়োগ করার ফলে এই ব্যাকরণটি ভাষা বিচার ও শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি আদর্শ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।
(c) জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য ‘ :
        বাঙালির জীবন-সংস্কৃতি ও সাহিত্য ভাবনা সম্পর্কে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি ‘জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য’ নামে। বাঙালি বিভিন্ন জাতির জীবন-সংস্কৃতি-ভাষা ও জীবিকার পথকে কীভাবে আত্মস্থ করেছে তার একটি প্রাঞ্জল ও তথ্যবহুল বিবরণ এতে আছে। বাঙালির জীবনে Confusion of issues বা বিষয়-বিভ্রম সৃষ্টির উপাদানও কম নয়। এই সম্পর্কে সতর্ক থাকার পরামর্শও তিনি দিয়েছেন।

(d) ‘ইতিহাস ও সংস্কৃতি’:
        ‘ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ প্রবন্ধটি ১৩৫১ বঙ্গাব্দে কানপুরে অনুষ্ঠিত প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে ‘ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ শাখার সভাপতির অভিভাষণে সুনীতিকুমার এটি পাঠ করেন। পরে তা ১৩৫১ বঙ্গাব্দের ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৪ ও ২১ শে মাঘ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটির প্রেক্ষাপট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ভারতবর্ষ। প্রবন্ধটির উদ্ভব হয়েছে সমাজমানসের এক রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকারণের সংকটলগ্নে ।

সুনীতিকুমারের গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্যঃ
(a) তাঁর গদ্য রীতিতে যেমন আছে ঋজুতা, তেমনি আছে গাম্ভীর্য। 
(b) তৎসম, ইংরেজী, দেশি সবরকমের শব্দ তিনি অনায়াসে ব্যবহার করেছেন।
(c) তিনি গদ্য রচনা শুরু করেছিলেন সাধুভাষা দিয়ে, পরে ধীরে ধীরে এক বৈঠকী গদ্য কথাকে তিনি অবলম্বন করেছেন যা হয়ে উঠেছে পরিশলিত ও অপভাষা বর্জিত ।

সুনীতিকুমারের স্বাতন্ত্রতা ঃ
           আচার্য সুনীতিকুমার ছিলেন জ্ঞানপিপাসু ও জ্ঞানতপস্বী এবং একই সঙ্গে জীবনপিপাসু ও জীবননিষ্ঠ। তাঁর জীবনচর্যাকে কোনো গণ্ডির মধ্যে সীমিত করা যায় না। তাঁর ছিল নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি। প্রাবন্ধিক হিসেবে এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য।

2 comments