Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

‘বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পি’ বিদ্যাসাগরঃ

    ‘‘বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পি ছিলেন । তিনিই সর্বপ্রথম বাংলা  গদ্যে কলা নৈপুন্যের অবতারণা করেন ।”                         ...

 

 
‘‘বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পি ছিলেন । তিনিই সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যে কলা নৈপুন্যের অবতারণা করেন ।” 
                                                  ------- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
                বাংলা গদ্যে যতি সন্নিবেশ করে , পদবন্ধে ভাগ করে এবং সুললিত শব্দবিন্যাস করে বিদ্যাসাগর তথ্যের ভাষাকে রসের ভাষায় পরিনত করেন । বাংলা গদ্যে এরকম ধ্বনি ঝংকার ও সুললিত সুরবিন্যাস যে সম্ভব তা আগে প্রায় কউ জানতেন না। 

    পরিচয় :   
        1820 খ্রিস্টাব্দের 26 সেপ্টেম্বর মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগর জন্মগ্রহণ করেন। পিতা - ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায়, মাতা - ভগবতী দেবী । বালক বয়স থেকে দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে বড়ো হন। অধ্যাপকরা 1841 খ্রিস্টাব্দে তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি প্রদান করেছিলেন। 1841 খ্রিস্টাব্দে তিনি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রধান পণ্ডিত নিযুক্ত হয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়; ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা নামেও স্বাক্ষর করতেন । 1846 খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ এবং 1850 খ্রিস্টাব্দে ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়েছিলেন। অজেয় পৌরুষত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। 1891 খ্রিষ্টাব্দের 29 জুলাই মৃত্যুবরণ করেন ।

   প্রথম রচনাঃ  
  • বিদ্যাসাগরের প্রথম বাংলা রচনা ‘মহাভারত উপক্রমনিকা ভাগ’ এর অনুবাদ । এটি প্রথম বর্ষে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় (1843 - 44 খ্রিষ্টাব্দে) ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় । 
  • বিদ্যাসাগরের চরিতকারেরা বলেন ভাগবতের কৃষ্ণলীলা অবলম্বনে রচিত ‘বাসুদেব চরিত’ তাঁর প্রথম গ্রন্থ , কিন্তু এই উক্তির কোনো প্রমাণ নেই । এর কোনো পান্ডুলিপি পাওয়া যায় নি । 
    গ্রন্থসমূহঃ    
 সংস্কৃত গ্রন্থ থেকে অনুবাদঃ
(a) ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ (1847) -- হিন্দি ‘বেতাল পচ্চিসী’র অনুবাদ । 
(b) ‘শকুন্তলা’ (1854) --- কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ এর অনুবাদ ।
(c) ‘সীতার বনবাস’ (1860) --- ভবভূতির ‘উত্তর রামচরিত’ (১ম ও ২য় খন্ড) এবং বাল্মিকীর ‘রামায়ণের’‘উত্তর কান্ড’ 
                                               অবলম্বনে রচিত । 
ইংরাজি গ্রন্থ থেকে অনুবাদঃ
(a) ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ (1848) -- মার্শম্যানের History of Bengal-এর কয়েক অধ্যায় অবলম্বনে রচিত ।
(b) ‘জীবনচরিত’ (1859) --- চেম্বার্সের 'Biographies'  অবলম্বনে রচিত ।
(c) ‘বোধোদয়’ (1851) --- চেম্বার্সের 'Rudiments of Knowledge' অবলম্বনে রচিত । 
(d) ‘কথামালা’ (1856) --- ঈশপের ‘ফেবলস্’ অবলম্বনে রচিত । 
(e) ‘আখ্যান মঞ্জুরী’ (1863) --- ঈশপের ‘ফেবলস্’ অবলম্বনে রচিত ।
(f) ‘ভ্রান্তিবিলাস (1869)  ---- শেক্‌পীয়রের Comedy of Errors এর গল্পাংশের অনুবাদ ।

মৌলিক গ্রন্থ:
(a) ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব’ (1853)
(b) ‘বাংলা ভাষা ও বাঙালী সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ (1853),
(এই দুটি গ্রন্থকে সাহিত্য সমালোচনা ও বিতর্কমূলক রচনা বলা যেতে পারে )
(c) ‘বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (১ম খন্ড - 1855, ২য় খন্ড - 1856)
(d) ‘বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’ (১ম খন্ড - 1873, ২য় খন্ড - 1873) 
(e) ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’ (আনুমানিক - 1863) -- স্মৃতিচারণামূলক মৌলিক গ্রন্থ ।  
(f) ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ (1891) ---- আত্মচরিত গ্রন্থ (গ্রন্থটি অসমাপ্ত) ।
(g) সম্প্রতি বিদ্যাসাগরের ‘অপূর্ব ইতিহাস’ সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতাদের সামনে এসেছে ।

ব্যঙ্গাত্মক রচনাঃ
(a) ‘অতি অল্প হইল’ (1873)  -------------  |   এই তিনখানি পুস্তক ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’
(b) ‘আবার অতি অল্প হইল’ (1873)          |   ছদ্মনামে রচিত । 
(c) ‘ব্রজবিলাস’ (1884)  -------------------|
(d) ‘রত্নপরীক্ষা’ (1886) -- ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপো সহচরস্য’ ছদ্মনামে প্রকাশিত । 
(e) ‘ঋজুপাঠ’ (1851 - 52) ।

শিশুপাঠ্য (শিক্ষনীয়):
(a) ‘বর্ণপরিচয়’ (দুইখন্ড - 1855),
(b) ‘বোধোদয়’ (1851),
(c) ‘কথামালা’ (1856), 
(d‘চরিতাবলী’ (1856) ।

** বিদ্যাসাগরের ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব’ (ক্ষুদ্রপুস্তিকা) ভারতবর্ষের প্রথম সাহিত্য - ইতিহাস রচনার চেষ্টা । এর অনুকরণে রামগতি ন্যায়রত্ন ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ রচনা করেন । 

     উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ    
(১) ‘বাসুদেব চরিত’:
         ১৮৪৭ থেকে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বিদ্যাসাগর অনেক গ্রন্থের অনুবাদ করেছিলেন। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দেরও পূর্বে তিনি ভাগবতের কৃষ্ণলীলা অবলম্বনে 'বাসুদেব চরিত' লিখেছিলেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় এই বই মুদ্রিত হয়নি। এর পাণ্ডুলিপিও মেলেনি।

(২) ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’:
            বিদ্যাসাগরের বন্ধুর বালিকাকন্যা প্রভাবতীর শোচনীয় মৃত্যুশোকের বশে রচিত। তাঁর বিপুল মনস্বিতার অন্তরালে কতখানি স্নেহকাতর হৃদয় ছিল তা এই ছোট্ট রচনাটি পড়লে বোঝা যাবে। রচনাটিতে বিদ্যাসাগরের শোকাপ্লুত হৃদয় আত্মপ্রকাশ করেছে।
(৩) ‘ভ্রান্তিবিলাস’:
       ‘ভ্রান্তিবিলাস' গ্রন্থটি ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে রচিত। গ্রন্থটি শেকসপিয়রের Comedy of Errors-এর গদ্যে অনুবাদ। শেকপিয়রীয় বিদেশি কাহিনিটিকে দেশীয় পরিচ্ছদ দেবার জন্য নাটকে পাত্রপাত্রীর নামধাম পালটে তিনি ভারতীয় নাম দিয়েছেন ; ফলে বিদেশি কাহিনি একেবারে এদেশি রূপ ধরেছে।

(৪) ‘সীতার বনবাস’:
            ভবভূতির ‘উত্তর রামচরিত’ এবং রামায়নের ‘উত্তরকান্ড’ অবলম্বনে বিদ্যাসাগর এই গ্রন্তটি রচনা করেন । রামচন্দ্রের প্রজা সন্তোষের অভিপ্রায় থেকে সন্তানসম্ভবা সীতাকে একাকী বাল্মিকীর তপোবনে নির্বাসন করার চিত্ত বিদারক কাহিনী এই গ্রন্থের বনিতব্য বিষয় । আটটি পরিচ্ছদে বিনস্ত এই গন্থের কাহিনী রাজসভায় সীতার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পরিনতিতে পৌছেছে । রামায়ণ কাহিনীকে তিনি যথাসম্ভব সংযত, সংহত ও সংক্ষিপ্তভাবে প্রকাশ করেছেন ।  

(৫) ‘শকুন্তলা’:
            কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটক অবলম্বনে বিদ্যাসাগর এই গ্রন্থটি রচনা করেন । এখানে তিনি আখ্যানভাগকে গদ্যে বিবৃত করতে গিয়ে মূল নাটকের সাতটি অঙ্ককে সাতটি পরিচ্ছদে ভাগ করে নিয়েছেন । রাজা দুষ্মন্ত ও আশ্রমকন্যা শকুন্তলার প্রেম ও পরিনয়, দুর্বাসার অভিশাপ, দুষ্মন্ত কর্তৃক শকুন্তলাকে প্রত্যাখ্যান ও পরবর্তীকালে পুত্র ভরতের মাধ্যমের উভয়ের মধ্যে মিলনলাভ ‘শকুন্তলা’র মূল বিষয়বস্তু ।    

     বাংলা সাহিত্যে গদ্যানুবাদে বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব :  
            বিদ্যাসাগরের অনুবাদগুলি যথার্থ মৌলিক গ্রন্থের মতো মর্যাদা পেয়েছে—কোনো কোনোটি প্রায় ক্লাসিক সাহিত্যের পর্যায়ে উঠে গেছে। তিনি জানতেন–অনুবাদ ভিন্ন অতি দ্রুত গদ্যভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি অসম্ভব। সেইজন্য নিছক রসচর্চা ছেড়ে দিয়ে সারস্বত প্রতিভাকে তিনি অনুবাদকর্মে নিয়োগ করেছিলেন। সাহিত্যগ্রন্থগুলির অনুবাদ স্বাভাবিক, সরস ও মূলানুগ হয়েছে—বলতে গেলে গদ্যানুবাদে তাঁর মতো কৃতিত্ব বাংলা সাহিত্যে অতি অল্প অনুবাদকই দেখাতে পেরেছেন।

 বিদ্যাসাগরের আত্মজীবনীটি বাংলা জীবনী সাহিত্যের সম্পদবিশেষঃ
    নানা কাজে ব্যস্ত বিদ্যাসাগর জীবনের উপাত্তে পৌঁছে যখন আত্মজীবনী রচনায় মনোনিবেশ করলেন, তখন নতুন সাহিত্যকর্মে বড়ো একটা স্পৃহা ছিল না, সময়ও ছিল না। তাই বাল্যজীবনের কাহিনি বলতে বলতে গ্রন্থ অর্ধপথেই থেমে গেছে। গ্রন্থটি শেষ হলে বাংলা সাহিত্যে একটি দুর্লভ ব্যক্তিত্বের আশ্চর্য প্রতিফলন লক্ষ করা যেত।

বাংলা গদ্যের জনক :
                 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগরকে ‘বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পি’ বলেছেন ।            
 বিদ্যাসাগর বাংলাগদ্যের শিল্পসম্মত রীতির উদ্ভাবয়িতা। আধুনিক কালের গদ্যে অনেক বৈচিত্র্য দেখা গেছে, কিন্তু পদান্বয় ও যতিবন্ধনে বিদ্যাসাগরকে আমরা ছাড়িয়ে নতুন পথ আবিষ্কার করতে পারিনি। বাংলা গদ্যের কায়ানির্মাণ, এর শ্রী ও হ্রী বিদ্যাসাগরের দান। 
 
‘‘বাংলা গদ্য ভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংযত করিয়া তাহাকে সহজগতি এবং কার্যকুশলতা দান করিয়াছেন...” উক্তির যথার্থতা :
             কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক বিদ্যাসাগর সম্পর্কে এই উক্তি করেন।
‘বাংলা গদ্যে যতি সন্নিবেশ করে, পদবন্ধে ভাগ করে এবং সুললিত শব্দবিন্যাস করে বিদ্যাসাগর তথ্যের ভাষাকে রসের ভাষায় পরিণত করেন। বাংলা গদ্যের মধ্যেও যে এরকম ধ্বনি-ঝংকার ও সুরবিন্যাস সম্ভব, তা তাঁর আগে কেউই জানতেন না। তাঁর পরিকল্পিত সাধুভাষাই প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে বাঙালির লেখনীর মুখে ভাষা যুগিয়েছে।

বিদ্যাসাগরের শ্রেষ্ঠ অনুবাদ কর্ম:
             বিদ্যাসাগরের শ্রেষ্ঠ অনুবাদকর্ম 'সীতার বনবাস'। এর প্রথমাংশ মাত্র ভবভূতির ‘উত্তমরামচরিত থেকে গৃহীত। বাকি সবটাই রামায়ণ কাহিনির ভিত্তিতে নিজস্ব বিন্যাস ও সৃষ্টি ক্ষমতার প্রকাশ। নানা পরিস্থিতির উদ্ভাবন করে পাত্রপাত্রীর চিত্তলোকের বিশ্লেষণ করে বিদ্যাসাগর আগতপ্রায় উপন্যাস সাহিত্যের পূর্বসম্ভাবনাকে স্ফুরিত করেছেন এই রচনায়।

অনুবাদ রচনার কারণঃ
        বিদ্যাসাগর ছিলেন ‘প্রাগমেটিক’ । প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখেই তিনি পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন । শুধু তাই নয়, তখনকার দুর্বল বাংলা ভাষাকে সবল, দৃঢ় করার জন্য বিভিন্ন সমৃদ্ধশীল ও উৎকৃষ্ট ভাষায় গ্রন্থকে বাংলায় অনুবাদ করে বাংলা ভাষার আদর্শ কি হওয়া উচিত তার পথনির্দেশ করেছেন ।

      বাংলা গদ্যের সংস্কারে বিদ্যাসাগরের অবদান :     
(ক) বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার নিজস্ব পদসংস্থানরীতি আবিষ্কার করেছিলেন, 
(খ) বাংলা গদ্যের মধ্যেও ছন্দের অস্তিত্ব অনুভব করে নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট পরিমাণ বিরতির সাহায্যে এই গদ্যের মধ্যে প্রাণপ্রবাহ কল্লোলিত করেছিলেন। 
(গ) বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে প্রয়োজনের সীমা ছাড়িয়ে রসের রাজ্যে নিয়ে গিয়েছিলেন। পূর্বসূরিদের মতো গালগল্পের প্রতি না ঝুঁকে কালিদাস শেকসপিয়রের ন্যায় উচ্চ প্রতিভার আশ্রয় নিয়েছিলেন।

No comments