Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

ঊনবিংশ শতাব্দীর শাক্ত পদকর্তা কমলাকান্ত ভট্টচার্যঃ

শাক্ত পদাবলির একজন বিশিষ্ট কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। মাতৃভাবের পারমার্থিক সঙ্গীত রচনায় সাধক কবি রামপ্রসাদের পরই কমলাকাস্তের স্থান। তিনি উচ্...


শাক্ত পদাবলির একজন বিশিষ্ট কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। মাতৃভাবের পারমার্থিক সঙ্গীত রচনায় সাধক কবি রামপ্রসাদের পরই কমলাকাস্তের স্থান। তিনি উচ্চস্তরের শক্তি সাধক ছিলেন। তাঁর গানে ভক্তিরস, সঙ্গীত রস ও কবিত্বের সমন্বয় ঘটেছে।

ব্যক্তি পরিচয়ঃ
        কবির নিবাস ছিল বর্ধমানের অন্তর্গত অম্বিকা কালনায়। তাঁর পিতার নাম মহেশ্বর, মাতার নাম মহামায়া। ছোটবেলায় তিনি শিক্ষার জন্য টোলে ভর্তি হন। পিতৃবিয়োগের পর তিনি মাতুলালয়ে চলে আসেন। মাতুলালয় ছিল খানা জংশনের কাছে চান্নাগ্রামে। চান্নার প্রসিদ্ধ বিশালাক্ষী দেবীর মন্দিরেই তার সময় কাটত। মাতৃপ্রেমে তিনি তন্ময় হয়ে থাকতেন। সেখানেই কালিকানন্দ ব্রহ্মচারী নামক এক সাধক তাঁকে মাতৃমন্ত্রের দীক্ষা দেন। সেখানে তিনি সাধনবলে মায়ের দর্শন লাভ করেন। গোপকন্যার বেশে ও নারী বাগ্দীর বেশে দেবী তাকে দেখা দেন। এভাবেই সাধক কমলাকান্ত অম্বিকা কালনা থেকে বর্ধমানে আসেন। বর্ধমানের অনতিদুরে কোটাল-হাট নামক স্থানে তার জন্য গৃহ নির্মিত হয়। এখনো সেখানে তার সাধনপীঠ রয়েছে। সাধক কমলাকান্ত এখানেই সাধনপীঠ নির্মাণ করে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন এবং সাধনপীঠেই তিনি দেহরক্ষা করেন।

পদ পরিচয়
        কথিত আছে, অম্বিকা কালনায় বসবাস করবার সময়েই তেজশ্চন্দ্র মহারাজের অন্যতম মহিষীর গর্ভজাত পুত্র মহারাজা প্রতাপচাঁদের সবিশেষ অনুরাগী হয়েছিলেন। মহারাজ তেজশ্চন্দ্রের যোগ্যতম উত্তরাধিকারী মহারাজ মহাতাবচাঁদ কমলাকান্তের নিজের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি থেকে প্রায় আড়াইশ মাতৃপদাবলি মুদ্রণ করে প্রকাশ করেছিলেন। বর্ধমান রাজবাটী প্রকাশিত কমলাকান্তের পদাবলি সংগ্রহে (শ্যাম সঙ্গীত) মোট ২৬৯টি পদ ছিল । তার মধ্যে ২৪৫টি শ্যামাবিষয়ক এবং ২৪টি বৈষ্ণবভাবাপন্ন রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক।
        শ্যামা মায়ের প্রতি অনন্যসাধারণ ভক্তি ও ঐকাস্তিক আত্মনিবেদনের নিদর্শন হিসাবে কমলাকাস্তের সঙ্গীতগুলি পরম আদরের সামগ্রী। 


কমলাকান্তের পদাবলীঃ
আগমনীঃ
➤ ‘আমি কি হরিলাম নিশি স্বপনে’’
➤ ‘‘আমার উমা এলো বলে’
➤ ‘এলো গিরি নন্দিনী লয়ে’
➤ ‘কবে যাবে বলো গিরিরাজ’
➤ কাল স্বপনে শঙ্করী মুখ হেরি’
➤ ‘কবে যাবে বল গিরিরাজ, গৌরীরে আনিতে’

বিজয়াঃ
➤ ‘ওরে নবমী নিশি না হয়ো রে অবসান’
➤ ‘কি হলো নবমী নিশি’
➤ ‘ফিরে চাও গো উমা, তোমার বিধুমুখ হেরি’

ভক্তের আকুতি পর্যায়ঃ
➤ ‘শুকনো তরু মঞ্জুরে না , ভয় লাগে মা ভাঙে পাছে’
➤‘মজিল মন ভ্রমরা’
➤ ‘জানি, জানি গো জননী’

পদাবলী প্রকাশঃ
        কমলাকান্তের ভনিতায় প্রায় তিনশো পদ পাওয়া গেছে ।  মহারাজ তেজশচন্দ্রের পুত্র মহারাজা মহাতাবচাঁদ কমলাকান্তের মৃত্যুর পর তাঁর হাতে লেখা প্রায় আড়াইশো ( ২৫০টি ) পদাবলী প্রকাশের উদ্যোগ নেন ।

রামপ্রসাদ ও কমলাকান্তের তুলনাঃ
    রামপ্রসাদ ছিলেন কবি ও ভাবুক। রামপ্রসাদ তাঁর গানগুলিকে শিল্পসমৃদ্ধ করতে চেষ্টা করেন। পক্ষান্তরে কমলাকান্ত ছিলেন কবি, ভাবুক ও শিল্পী। তাই তাঁর গানে রয়েছে ভক্তির আবেগ, সংগীতরস ও পরিমার্জিত শিল্পোৎকর্ষ সাধক কমলাকান্ত রামপ্রসাদের পরবর্তীকালের কবি। কমলাকাস্তের সময়ে কলকাতায় আধুনিকতার হাওয়া বইছে পুরোদমে। ভারতপথিক রামমোহন রায় তখন কলকাতায় জ্ঞানের মশাল হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সুতরাং সমকালীন পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষার আদর্শগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কমলাকান্ত অল্পবিস্তর অবহিত ছিলেন। তাই তাঁর পদাবলিতে শিল্পগুণের পরিচয় পাওয়া যায়।

শাস্ত্র গীতিকার কমলাকান্তের বৈশিষ্ট্যঃ
        রামপ্রসাদের গানে যেমন বাস্তবচিত্র রয়েছে, কমলাকান্তের গানে তার একান্ত অভাব। তাঁর গানে রয়েছে ভক্তিরসের নিবিড়তা ও আধ্যাত্মিক গভীরতা কমলাকান্ত একাধারে সাধক কবি ও শিল্পী বলে মনের ভাবকে তিনি ছন্দ-সৌন্দর্যে, অলংকরণ সজ্জায় এবং সুষম ও শ্রুতিমধুর শব্দ ঝংকারে শিল্পসম্মত রূপ দিয়েছেন। তাঁর গানের বিন্যাস পদ্ধতি মার্জিত ও পরিমিত। সুনির্বাচিত শব্দ, ছন্দ ও অলংকারের প্রয়োগ ঐচিত্যে কমলাকান্ত অন্তরের ভক্তিভাবুকতাকে অপূর্ব কাব্যশ্রী দান করেছেন।

কমলাকান্তের পদের প্রধান লক্ষণীয় বিষয়ঃ
        কমলাকাস্তের সমস্ত পদের প্রধান লক্ষণীয় বিষয় একটা ক্লাসিক সংহতি। ভাব ও রূপের অপূর্ব যুগলমূর্তি রচিত হয়েছে তাঁর পদাবলিতে। 

শাক্তপদাবলি রচনায় কমলাকান্তের কৃতিত্বঃ
            ভক্তিভাব, কবিত্ব ও শিল্পোৎকর্ষের ত্রিবেণী সঙ্গম ঘটেছে কমলাকান্তের পদে। শ্যামার পদতলে আত্মসমর্পণে পরমার্থ প্রাপ্তি হেতু বিষয়বাসনা বিমুক্ত কবিচিত্তের আনন্দচেতনার সুসংহত প্রকাশ ঘটেছে ভক্ত ও সচেতন কবির কবিতায়। কমলাকান্ত পারিবারিক জীবনের শান্ত পটভূমিতে আত্মোপলব্ধিতে মূলধন করে জ্ঞান, ভক্তি ও রুচির সুন্দর সমন্বয় সাধন করেছেন। সর্বোপরি মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণে, চরিত্র পর্যালোচনায় বিভিন্ন ভাবের উদ্‌বোধনে তিনি অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন।


ব্যাখ্যা ঃ ‘শুকনো তরু মুঞ্জরে না, ভয় লাগে মা ভাঙে পাছে। তরু পবন বলে সদাই দোলে, প্রাণ কাঁপে মা, থাকতে গাছে।'
         পঙক্তি দুটি কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের ভক্তের আকুতি বিষয়ক একটি উৎকৃষ্ট শাক্তপদ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এখানে কবি নিজেকে গাছের সঙ্গে তুলনা করে একটি সার্থক উপমার সাহায্যে তাঁর মনের আকুতি ব্যাখ্যা করেছেন।

এক নজরে কমলাকান্ত ভট্টাচার্য


1. ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন শাক্ত পদকর্তা হলেন কমলাকান্ত ভট্টচার্য।
2. কমলাকান্তের প্রকৃত নাম কমলাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ।
3. কমলাকান্তের পদবী বন্দ্যোপাধ্যায় ।
4. বর্ধমান জেলার অম্বিকা কালনা গ্রামে মাতুলালয়ে আনুমানিক ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন । ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান ।
5. কমলাকান্তের পিতা মহেশ্বর, মাতা মহামায়া ।
6. কমলাকান্ত বর্ধমান রাজ তেজসচন্দ্রের সভাকবি ।
7. কমলাকান্তের লিখিত গ্রন্থ ‘সাধকরঞ্জন’ ( তন্ত্র সাধনা গ্রন্থ )।
8. কমলাকান্তের সাধন ক্ষেত্র ছিল বর্ধমানের কোটালহাট ।
9. কমলাকান্তকে মাতৃমন্ত্রের দীক্ষা দেন কালিকানন্দ ব্রহ্মচারী ।
10. গোপকন্যার বেশে ও নারী বাগদির বেশে দেবী কবিকে দেখা দেন ।
11. কমলাকান্তের ভনিতায় প্রায় তিনশো পদ পাওয়া গেছে ।
12. মহারাজ তেজশচন্দ্রের পুত্র মহারাজা মহাতাবচাঁদ কমলাকান্তের মৃত্যুর পর তাঁর হাতে লেখা প্রায় আড়াইশো ( ২৫০টি ) পদাবলী প্রকাশের উদ্যোগ নেন ।
13. 
বর্ধমান রাজবাড়ি থেকে প্রকাশিত কমলাকান্তের পদাবলী সংগ্রহে (শ্যামা সংগীত) মোট ২৬৯টি পদ ছিল । তার মধ্যে ২৪৫টি শ্যামা বিষয়ক এবং ২৪টি বৈষ্ণব ভাবাপন্ন রাধাকৃষ্ণ বিষায়ক।

No comments