Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

জানা অজানায় বুদ্ধদেব বসু :

যে যুগে যে সমাজে ব্যক্তির কোনো নিজস্ব মর্যাদা নেই, ব্যক্তির ব্যক্তিত্বই অবলুপ্তির পথে; সেখানে ব্যক্তির প্রেমের প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা ও শিল্প ...


যে যুগে যে সমাজে ব্যক্তির কোনো নিজস্ব মর্যাদা নেই, ব্যক্তির ব্যক্তিত্বই অবলুপ্তির পথে; সেখানে ব্যক্তির প্রেমের প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা ও শিল্প শক্তিমত্তার অধিকার দাবি প্রকারান্তরে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যেরই বিজয় ঘোষণা। যুগের সংকীর্ণতা, সৌন্দর্যহীনতা ও যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে কবির সংবেদনশীল আত্মা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সেই অদ্ভুত সময়ে বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন বুদ্ধদেব বসু । তিনি ছিলেন বিংশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকের নতুন কাব্যরীতির সূচনাকারী অন্যতম কবি ।

  পরিচয় :  
        বুদ্ধদেব বসু বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লায় ১৯০৮ সালের ৩০ শে নভেম্বর জন্মগ্রহন করেন । পিতা ভূদেব বসু, মাতা বিনয়কুমারী দেবী । পৈতৃক আদি নিবাস বর্তমান বাংলাদেশের বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রাম । ১৯২৫ সালে বুদ্ধদেব বসু ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করে । ১৯২৭ সালে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে বুদ্ধদেব বসু আই.এ পাশ করেন । ১৯৩০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন । বুদ্ধদেব বসু ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের একজন যশস্বী অধ্যাপক । জীবনের শেষ পর্বে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন । ১৯৭৪ সালের ১৮ ই মার্চ  বুদ্ধদেব বসু পরলোকগমন করেন ।

   রচনাসমূহঃ   
প্রথম রচনা :
(a) ১৯২১ সালে অর্থাৎ ১৩২১ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যায় নারায়ণ মাসিক পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু -র প্রথম কবিতা - “যাত্রী” প্রকাশিত হয় ।
(b) ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে বুদ্ধদেব বসু -র প্রথম কাব্যগ্রন্থ - “মর্মবাণী” প্রকাশিত হয় ।
(c) “সাড়া” বুদ্ধদেব বসু -র প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস, যেটি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।

    সম্পাদিত পত্রিকা ঃ   
(a) বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত পত্রিকা – প্রগতি (১৯২৭), কবিতা (১৯৩৫) ।
(b) ত্রৈমাসিক ‘কবিতা’ পত্রিকা টি বুদ্ধদেব বসু প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং সমর সেনের সহযোগিতায় সম্পাদনা করেন ।
(c) ১৯৩৮ সালে বুদ্ধদেব বসু হুমায়ূন কবিরের সাথে ত্রৈমাসিক‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন ।
     বুদ্ধদেব বসু রচিত কাব্যগ্রন্থ :     
  • ‘মর্মবাণী’ -  ১৯২৫
  •  ‘বন্দীর বন্দনা’ ১৯৩০
  • ‘একটি কথা’ - ১৯৩২
  • ‘পৃথিবীর প্রতি’ - ১৯৩৩
  • ‘কঙ্কাবতী ও অন্যান্য কবিতা’ -  ১৯৩৭ , ১৯৪৩ (দ্বিতীয় সংস্করণ)
  • ‘আমি চঞ্চল হে’ - ১৯৩৭
  • ‘পরিক্রমা’ - ১৯৩৮
  • ‘নতুন পাতা’ -  ১৯৪০
  • ‘এক পয়সায় একটি’ -  ১৯৪২
  • ‘বাইশে শ্রাবণ’ - ১৯৪২
  • ‘দময়ন্তী’ -  ১৯৪৩
  • ‘রূপান্তর’ -  ১৯৪৪
  • ‘দ্রোপদীর শাড়ি’ -  ১৯৪৮
  • ‘শীতের প্রার্থনা বসন্তের উত্তর’ -  ১৯৫৫
  • ‘যে আঁধার আলোর অধিক’ -  ১৯৫৮
  • ‘মরচে পড়া পেরেকের গান’ -  ১৯৬৬
  • ‘একদিন চিরদিন’ - ১৯৭১
  • ‘ স্বাগত বিদায়’ -  ১৯৭১
  • ‘বিদায় ও অন্যান্য কবিতা’ - ১৯৭১
 
   বুদ্ধদেব বসু রচিত কাব্যনাট্য :    
            বুদ্ধদেব বসুর কাব্যনাটকে আশা-যন্ত্রণা দ্বন্দ্ব-গভীর উপলব্ধি যথাযথভাবে প্রকাশিত হয়েছে ।
  • ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী‌’ -  ১৯৬৬
  • ‘কালসন্ধ্যা’ -  ১৯৬৮
  • 'অনান্নী অঙ্গনা' (১৯৭০), 
  • 'প্রথম পার্থ' (১৯৭০), 
  • 'সংক্রান্তি' (১৯৭৩), 
  • 'প্রায়শ্চিত্ত' (১৯৭৩), 
  • 'ইক্কাকু সেন্নিন' (১৯৭৩) ইত্যাদি।

     গদ্য নাটক :     
  • ‘কলকাতার ইলেকট্রা' (১৯৬৮), 
  • ‘পুনর্মিলন' (১৯৭০), 
  • 'নেপথ্য নাটক' (১৯৭০) ইত্যাদি।   

     একাঙ্ক নাটক :      
  • ‘পাতা ঝরে যায়' (১৯৬৬), 
  • 'বাবু ও বিবি' (১৯৬৬), 
  • 'সত্যসন্ক' (১৯৬৭), 
  • 'চরম চিকিৎসা’ (১৯৬৮), 
  • ‘একটি মেয়ের জন্য’
  • ‘কুড়ি বছর আগে অথবা পরে’,
  •  ‘হিতাকাঙ্ক্ষী' ইত্যাদি।

      বুদ্ধদেব বসু রচিত উপন্যাস :     
  • ‘সাড়া’ -  ১৯৩০
  • ‘ অর্কমন্য’ -  ১৯৩১
  • ‘মন দেয়া নেয়া’ -  ১৯৩২
  • ‘রডোডেনড্রন গুচ্ছ’ -  ১৯৩২
  • ‘আমার বন্ধু’ - ১৯৩৩
  • ‘সানন্দা’ -  ১৯৩৩
  • ‘যেদিন ফুটিল কমল’ -  ১৯৩৩
  • ‘সূর্যমুখী’ - ১৯৩৪
  • ‘পরম্পর’ - ১৯৩৪
  • ‘একদা তুমি প্রিয়ে’ -  ১৯৩৪
  • ‘ লাল মেঘ’ -  ১৯৩৪
  • ‘পরিক্রমা’ -  ১৯৩৮
  • ‘কালো হাওয়া’ -  ১৯৪২
  • ‘তিথি ডোর’ -  ১৯৪৯
  • ‘নির্জন স্বাক্ষর’ - ১৯৫১
  • ‘মৌলিনাথ’ -  ১৯৫২
  • ‘রাত ভোর বৃষ্টি’ -  ১৯৬৭
  • ‘পাতাল থেকে আলাপ’ -  ১৯৬৭
  • ‘গোলাপ কেন কালো’ -  ১৯৬৮
  • ‘বিপন্ন বিস্ময়’ - ১৯৬৯

      বুদ্ধদেব বসু রচিত গল্পগ্রন্থ :      
  • ‘অভিনয় নয় ও অন্যান্য গল্প’ - ১৯৩০
  • ‘রেখাচিত্র ও অন্যান্য গল্প’ -  ১৯৩১
  • ‘এরা ওরা এবং আরো অনেক’ -  ১৯৩২
  • ‘অদৃশ্য শত্রু ’ - ১৯৩৩
  • ‘প্রেমের বিচিত্র গতি’ -  ১৯৩৪
  • ‘মিসেস গুপ্ত’ -  ১৯৩৪
  • ‘ঘরেতে ভ্রমর এল’ -  ১৯৩৫
  • ‘নতুন লেখা’ -  ১৯৩৬
  • ‘ফেরিওয়ালা ও অন্যান্য গল্প’ -  ১৯৪১
  • ‘খাতার শেষ পাতা’ -  ১৯৪৩
  • ‘হাওয়া বদল’ -  ১৯৪৩
  • ‘ভাসো আমার ভেলা’ -  ১৯৬৩
  • ‘হৃদয়ের জাগরণ’ -  ১৯৬৮
  • ‘প্রেমপত্র’ -  ১৯৭২

    বুদ্ধদেব বসু রচিত প্রবন্ধগ্রন্থ :    
  • ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’ -  ১৯৩৫
  • ‘আমি চঞ্চল হে’ -  ১৯৩৬
  • ‘সমুদ্র তীর‌’ -  ১৯৩৭
  • ‘সব পেয়েছির দেশ’ -  ১৯৪১
  • ‘উত্তর তিরিশ’ -  ১৯৪৫
  • ‘কালের পুতুল’ -  ১৯৪৬
  • ‘রবীন্দ্রনাথ : কথাসাহিত্য’ -  ১৯৫৪
  • ‘স্বদেশ ও সংস্কৃতি’ -  ১৯৫৭
  • ‘সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথ’ -  (১৯৬৩)
  • ‘কবি রবীন্দ্রনাথ’ -  ১৯৬৬
    বুদ্ধদেব বসু রচিত স্মৃতিচারণা মূলক রচনা :     
  • ‘আমার ছেলেবেলা’ -  ১৯৭৩
  • ‘আমার যৌবন’ -  ১৯৭৬

      বুদ্ধদেব বসুর অনুদিত কাব্যগ্রন্থ :    
  • ‘মেঘদূত’ -  ১৯৫৭
  • ‘শার্ল বোদলেয়ার : তাঁর কবিতা’ -  ১৯৬১
  • ‘হোণ্ডার্লিনের কবিতা’ -  ১৯৬৭

     বুদ্ধদেব বসু কতৃক উৎসর্গীকৃত বিভিন্ন রচনা :    
  •  "মর্মবাণী" – দাদামহাশয় কে ।
  • "বন্দীর বন্দনা" – অজিত কুমার দত্ত কে ।
  • "নতুন পাতা" – স্ত্রী প্রতিভা বসু কে ।
  • "দময়ন্তী" – সমর সেন এবং জীবনানন্দ দাশ কে ।
  • "দ্রোপদীর শাড়ি" – সৌরেন সেন কে ।


     বুদ্ধদেব বসুর প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননা :     
(a)  ১৯৬৭ সালে “তপস্বী ও তরঙ্গিনী” কাব্যনাট্যের জন্য বুদ্ধদেব বসু সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন ।
(b)  ১৯৭০ সালে তিনি পদ্মবিভূষণ উপাধিতে সম্মানিত হন ।
(c)  ১৯৭৪ সালে “স্বাগত বিদায়” কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি মরনোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন ।

   অন্যান্য বিষয়  :    
  • কল্লোল যুগের তরুণতম প্রতিনিধি ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ।
  • বুদ্ধদেব বসু শার্ল বোদলেয়ারের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন ।
  • বুদ্ধদেব বসুর ‘রজনী হ’লো উতলা’ গল্পটির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে অশ্লীল এবং চোরাই বলে ।
  • অশ্লীলতা-বিতর্ক বুদ্ধদেব বসুর ‘সাড়া’ উপন্যাসটিও বিদ্ধ। অভিযোগ আদালত, পুলিশ পর্যন্ত গড়ায় ।
  • বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত - বন্ধুত্রয়ী একত্রে দুইখানি উপন্যাস রচনা করেন – ‘বিসর্পিল’ এবং ‘বনশ্রী’ ।
  • ১৯৩২-এর ডিসেম্বরে ‘এরা আর ওরা এবং আরো অনেক‘ গল্পগ্রন্থ-এর জন‍্যেও আদালতে অভিযোগ উঠেছিল।
  • জীবনের উপান্তে এসে বেশ কয়েকদিন আদালতে যেতে হয়েছিল ‘রাত ভ‘রে বৃষ্টি‘ উপন্যাসের জন্য।

   বাংলা কাব্যে কবি বুদ্ধদেব বসুর অবদান  :     
১.কবি বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় যে অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা যায় তা দেহ ও আত্মার দ্বন্দ্ব, আদর্শ ও বাস্তবের দ্বন্দ্ব, ধবৃত্তি ও প্রেমের দ্বন্দ্ব।
২. প্রেম, রোমানা আর সৌন্দর্যের আরাধনার পাশাপাশি দেহ - কামনার রক্তরাগ সঞ্চিত হয়েছে বুদ্ধদেব বসুর কবিতায়।
৩. রোমান্টিক প্রকৃতি তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। 
৪. বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় পালা বদলের ইঙ্গিত পাওয়া যায় ।
৫. বুদ্ধদেব বসু আঙ্গিকের দিক দিয়ে দুর্বোধ্যতা ও বাচনবক্রতা থেকে কবিতাকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন।

    বুদ্ধদেব বসুকে ‘সাহিত্যের সব্যসাচী' বলার কারণ :    
           বুদ্ধদেব বসু গল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা ও ভ্রমণ সাহিত্য, প্রবন্ধ, নাট্যকাব্য, অনুবাদ ও শিশুসাহিত্য, সর্বোপরি গীতিকবিতা, গদ্য ও পদ্যবন্ধে অর্থাৎ সাহিত্যের প্রায় সর্ববিভাগেই আজীবন নব নব পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এই কারণে তাঁকে 'সাহিত্যের সব্যসাচী' বলা হয়।

  রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কাব্যসাহিত্যে অভিনবত্বের অগ্রদূত হিসেবে বুদ্ধদেব বসুর মূল্যায়ন :   
        কবি বুদ্ধদেব বসু সর্বপ্রথম দৃঢ়তার সঙ্গে রবীন্দ্রভাবাদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নতুন কাব্যসাধনার নান্দীপাঠ করেছিলেন। ঢাকার ‘প্রগতি’র তিনিই ছিলেন নেতৃস্থানীয়। পরে কলকাতায় এসেও আধুনিক বাংলা কবিতার লালনভার তিনি তুলে নিলেন।

    আধুনিক কাব্যসাহিত্যে বুদ্ধদেব বসুর বিশিষ্টতা :  
        ‘বন্দীর বন্দনা’, ‘কঙ্কাবতী’, ‘দময়ন্তী’, ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’, ‘শীতের প্রার্থনা—বসন্তের উত্তর প্রভৃতি কাব্যরচনা করে বুদ্ধদেব বসু সাম্প্রতিক কবিকুলের প্রথম সারিতে স্থান পেয়েছেন। তাঁর কবিতার দেহ অতিমার্জিত। তবে দুর্বোধ্যতা এবং বাচনবক্রতা থেকে তাঁর কবিতা অনেকখানি মুক্ত। তিনি দেহকামনার রক্তরাগ সঞ্চারিত করেছেন তাঁর প্রেমকবিতায়। উপলব্ধির প্রগাঢ় তীব্রতা এদের মধ্যে প্রকাশিত। তবে বুদ্ধদেব বসু যে অন্তরের অন্তস্থলে রোমান্টিক, কবির বেশি বয়সের কবিতায় তার প্রমাণ মিলেছে । 

1 comment