Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

চন্ডিদাস ও তার পদাবলীঃ

মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ভাবগত ও ভাষাগত তা দিক দিয়ে যিনি বাঙালি চিত্তকে পদাবলির অমৃতময় কাব্যরস সিঞ্চনে সিক্ত করে আপ্লুত করেছেন, তি...

মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ভাবগত ও ভাষাগত তা দিক দিয়ে যিনি বাঙালি চিত্তকে পদাবলির অমৃতময় কাব্যরস সিঞ্চনে সিক্ত করে আপ্লুত করেছেন, তিনি হলেন পদাবলির চণ্ডীদাস। স্বয়ং মহাপ্রভুও এই গানের রসাস্বাদন করে বিহ্বল হতেন। চণ্ডীদাস আটপৌরে সাধারণ ভাষায় যে কাব্যপ্রতিমা নির্মাণ করেছেন, তাতে অলংকারের বাহুল্য নেই, আছে হৃদয় নিংড়ানো পূর্বরাগ থেকে মাথুর আবেগ। সামান্য দু-একটি ইঙ্গিতেই তিনি রাধা-হৃদয়ের মর্মবেদনা ফুটিয়ে তুলেছেন। চণ্ডীদাসের রাধা দুঃখের মধ্যে দিয়ে প্রেমকে সার্থক করে তুলতে চান।

পরিচয়ঃ
        চণ্ডীদাসের জন্মকাল ও জীবন পরিচয় সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। জনশ্রুতি অনুসারে বীরভূম জেলার নান্নুর গ্রামে, মতান্তরে বাঁকুড়ার ছাতনা গ্রামে আনুমানিক - ১৪১৭ খ্রিঃ তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম - দুর্গাদাস বাগচী। এঁরা ছিলেন বর্ণে ব্রাহ্মণ । কবি ছিলেন বাশুলী দেবীর উপাসক।তিরোধানঃ- ১৪৪৭ খ্রিঃ ।

চন্ডীদাস সমস্যাঃ
        বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পুঁথি আবিস্কার করলে চন্ডীদাস সমস্যার উদ্ভব হয় । এই সময় চারজন চন্ডিদাসের কথা জানা যায় । এই চারজন চন্ডিদাস হলেনঃ
(a)‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রচয়িতা বড়ু চন্ডীদাস ( প্রাক চৈতন্যযুগের)।
(b) সর্বোত্তম পদ রচয়িতা দ্বিজ চন্ডীদাস ( প্রাক চৈতন্যযুগের) ।
(c) পালাগান রচয়িতা দীন চন্ডীদাস (চৈতন্য পরবর্তী যুগের) ।
(d) সহজিয়া চন্ডীদাস (চৈতন্য পরবর্তী যুগের) ।



পদ পরিচয়ঃ
চন্ডিদাসের পদগুলিকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায় । ভাগগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ
পূর্বরাগ
* ‘সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম’
* ‘রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা’
* ‘একে কুলবতী ধনি তাহে সে অবলা’
* ‘এমন পিরীতি কভু নাহি দেখি শুনি’
* ‘জল বিনু মীন যেন বন্ধু না জীয়ে’

অভিসার
* ‘এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা
        কেমনে আইল বাটে
আঙ্গিনার মাঝে বঁধুয়া ভিজিছে
     দেখিয়া পরাণ ফাটে।’

আক্ষেপানুরাগ
* ‘যত নিবারিতে চাহি নিবারনা যায় রে’
* ‘মরিয়া হইব শ্রী নন্দের নন্দন তোমারে কবির রাধা’
* ‘কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান’
* ‘ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর’
* ‘কালো জল ঢালিতে সই কালা পড়ে মনে’

নিবেদন
* ‘বঁধু কি আর বলিব আমি’
* ‘বঁধু তুমি সে আমার প্রাণ’
* ‘পিরীতি রসেতে ঢালিতনু মন’
* কলঙ্কী বলিয়া ডাকে সব লোকে’


কবি কৃতিত্বঃ
ক) চণ্ডীদাসের রাধা যেন অনন্ত আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তার কৃষ্ণপ্রেম ব্যাখ্যার অতীত, শুধু এক উপলব্ধির বিষয়। এইভাবে সামান্য আয়োজনে চণ্ডীদাস অসামান্য শিল্পনৈপুণ্য দেখিয়েছেন।
খ) প্রতিদিনের জীবন থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই চণ্ডীদাস ফুটিয়ে তুলেছেন ভাষাহীন, প্রকাশহীন বেদনার এক আশ্চর্য সুর।
গ) চন্ডিদাসের কাব্যের একটি মূলসুর মানবপ্রীতি ও মর্ত্যপ্রীতি । তার সেই বহুবিশ্রুত পদটি তার প্রমাণঃ ‘ শুনহ মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই ।’
                এই কারণেই সাহিত্য সমালোচকেরা চণ্ডীদাসকে আধুনিক গীতিকবিদের সঙ্গে একাসনে বসানোর পক্ষপাতী।

চন্ডিদাসের পদাবলীর অভিনবত্বঃ
        প্রেমের গভীরতায় এবং আন্তরিকতায় চণ্ডীদাসের পদাবলির তুলনা নেই। বৈষ্ণুবদের সাধনমার্গের সর্বপ্রধান অবলম্বন 'রাধা-ভাব’ । চণ্ডীদাসের রচনায় এই ভাবটি সর্বত্রই প্রস্ফুটিত শতদলের ন্যায় বিকশিত।

চন্ডিদাসের পদাবলীর ঐতিহাসিক গুরুত্বঃ
            চণ্ডীদাস সম্বন্ধে সাহিত্য—ইতিহাসের মুখ্য জিজ্ঞাসা কবি-সংখ্যা বা তাঁদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পরিচয় নিয়ে নয়। ঐতিহ্যের সন্ধান ও মূল্য নির্ণয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দায়িত্ব। এদিক থেকে চণ্ডীদাসের ভণিতায় প্রচলিত কিছু সংখ্যক রাধাকৃষ্ণলীলা পদাবলি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সুমহৎ ঐতিহ্য ; তাঁর দেশকালোত্তীর্ণ রসমাধুর্যে বাংলা সাহিত্যের পাঠকের চিরন্তন উত্তরাধিকার। কেবল এই কারণেই, এই বিশেষত সৃষ্টির উন্মেষ পরিচয় ইতিহাসের অপরিহার্য জিজ্ঞাস্য বিষয়।

চন্ডিদাসের শিল্পচেতনাঃ
        চণ্ডীদাসের কবিতায় ভাবগভীরতা রূপ ধরেছে শব্দবন্ধে। অথচ আপাতদৃষ্টিতে শব্দবন্ধ অলংকরণের প্রতি কোনো প্রবণতাই কবির নেই। চণ্ডীদাসে প্রসাধন নেই, কিন্তু স্বাভাবিক রূপসিদ্ধি আছে। কবি যেন চেষ্টা না করেই শব্দে শব্দে ছবির আভাস দিয়েছেন, কবির সংকেতে রহস্যগভীর ভাবব্যাকুলতা ফুটিয়ে তুলেছেন। এই গভীরতাই শিল্পচেতনা।

পরবর্তী পদ সাহিত্যে চন্ডিদাসের প্রভাবঃ
        চৈতন্যোত্তর পদকর্তারা চণ্ডীদাসের ভাব কল্পনার সঙ্গে নিজেদের বিশ্বাসকে সহজে মেলাতে পারতেন না। কিন্তু তাঁর সৃষ্ট পদাবলি কাব্যরীীতির এবং ভাবগভীরতার এমন এক অভিনব পথ দেখিয়ে দিল যাতে পরবর্তীকালে পদকর্তাদের একটি শ্রেণি এই আদর্শের অনুবর্তন করতে লাগলেন। তাঁদের পুরোভাগে আছেন বৈষুব কবিতার অন্যতম প্রধান শিল্পী জ্ঞানদাস।

পদাবলীর চন্ডিদাসের রচনা বৈশিষ্ট্যঃ
(ক) কাব্যের বাণী সহজ সরল সুন্দর স্বচ্ছ। শব্দের ঐশ্বর্য অপেক্ষা শব্দের অল্পতাই ইঙ্গিতে বেশি কার্যকরী।
(খ) চেষ্টাকৃত কবিত্ব প্রকাশের প্রয়াস দেখা যায় না।
(গ) চণ্ডীদাসের পদাবলিতে রূপকের আড়ালের এমন একটা আধ্যাত্মিক জগৎ লুকিয়ে আছে—যার মাধুরী ভক্তের কাছে অপরিসীম।
(ঘ) সর্বজনীন ও সার্বভৌম রসাবেদন।

চন্ডিদাসের কাব্যের মৌলিকতাঃ
        গ্রামীণ বাংলার মরমিয়া কবি চণ্ডীদাসের পাণ্ডিত্য ছিল না। সহজ অনুভবের পথ ধরেই তাঁর কাব্যসাধনা। অলংকার শাস্ত্রের সঙ্গে জীবনরসকে তিনি মিলিয়ে বিধিসম্মত কাব্য রচনা করেছেন। চণ্ডীদাসের ভাষা সহজ। তিনি সহজ ভাষায় সহজ ভাবের সহজ কবি। গ্রামীণ মাধুর্য, আবেগের গভীরতা ও দুঃখবোধের দ্যোতনায় তাঁর কাব্য প্রেমচেতনা ও ভক্তিভাবুকতার অপূর্ব মাধুর্যে ভরে উঠেছে।

চন্ডিদাসের সাথে বিদ্যাপতির পার্থক্যঃ
            চণ্ডীদাস গ্রামবাংলার কবি। পাণ্ডিত্যবর্জিত সহজসরল ভাষায় তিনি রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক পদ রচনা করেন। অন্যদিকে বিদ্যাপতি নাগরিক কবি পণ্ডিত। তাই তাঁর রচনায় বাকবৈদগ্ধ ও মণ্ডলকলার বৈচিত্র্য আছে। রবীন্দ্রনাথের মতে :
(ক) ‘বিদ্যাপতি সুখের কবি, চণ্ডীদাস দুঃখের কবি'।
(খ) ‘চণ্ডীদাস গভীর এবং ব্যাকুল, বিদ্যাপতি নবীন এবং মধুর'।

চন্ডিদাস সম্পর্কে কিছু উক্তিঃ
ক) ‘চন্ডীদাস সহজ ভাষায় সহজ ভাবের কবি’- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
খ) ‘চন্ডীদাস দুঃখের কবি’- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
গ) চন্ডীদাসের পদ ‘রুদ্রাক্ষের মালা’- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ।
ঘ) চন্ডীদাস ‘সায়াহ্ন সমীরনের দীর্ঘশ্বাস’- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
ঙ) চন্ডীদাস ‘কবি তাপস’- শঙ্করীপ্রসাদ বসু ।
চ) চন্ডীদাস ‘রসকাব্যের অলি’- জ্ঞানদাস ।

এক নজরে চন্ডিদাস


1. চন্ডীদাস ছিলেন বৈষ্ণব কবি ।
2. চন্ডীদাস বীরভূমের নান্নুরে আনুঃ ১৪১৭ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন ( মতান্তরে বাঁকুড়া জেলার ছাতিনা গ্রাম ) ।
3. চন্ডীদাসের আবির্ভাব কাল চতুর্দশ শতাব্দীর উত্তর পর্বে অথবা পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমে ।
4. বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পুঁথি আবিস্কার করলে চন্ডীদাস সমস্যার উদ্ভব হয় ।
5. চন্ডীদাস সমস্যাঃ
(a) ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রচয়িতা বড়ু চন্ডীদাস ( প্রাক চৈতন্যযুগের)।
(b) সর্বোত্তম পদ রচয়িতা দ্বিজ চন্ডীদাস ( প্রাক চৈতন্যযুগের) ।
(c) পালাগান রচয়িতা দীন চন্ডীদাস (চৈতন্য পরবর্তী যুগের) ।
(d) সহজিয়া চন্ডীদাস (চৈতন্য পরবর্তী যুগের) ।
6. গ্রাম বাংলার কবি / আত্মমগ্ন কবি / মরমিয়ার কবি বলা হয় চন্ডীদাস কে ।
7. বাংলা পদাবলী সাহিত্য সর্বপ্রথম রচনা করেন চন্ডীদাস ।
8. পদাবলীর চন্ডীদাসের পিতার নাম দুর্গাদাস বাগচী ।
9. চন্ডীদাস বাসুলী ( বিশালাক্ষী ) দেবীর উপাসক ছিলেন ।
10. চন্ডীদাস জাতিতে ছিলেন ব্রাহ্মণ ।
11. চন্ডীদাস চৈতন্য পূর্ব যুগের কবি ।
12. চন্ডীদাসের সাধন সঙ্গিনী ছিলেন রামী নামে এক রজকিনী ।
13. চন্ডীদাস সহজিয়াপন্থী কবি ছিলেণ ।
14. পূর্বরাগ পর্যায়ের পদে চন্ডীদাস শ্রেষ্ঠ ।
15. চন্ডীদাস সহজ ভাষায় সহজ ভাবের কবি’- একথা বলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
16. চন্ডীদাসকে ‘দুঃখের কবি’ বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
17. চন্ডীদাসের পদগুলিকে ‘রুদ্রাক্ষের মালা’- বলেছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ।
18. চন্ডীদাসকে ‘সায়াহ্ন সমীরনের দীর্ঘশ্বাস’- বলেছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ।
19. চন্ডীদাসকে ‘কবি তাপস’- বলেছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু ।
20. চন্ডীদাসকে ‘রসকাব্যের অলি’- বলেছেন জ্ঞানদাস ।
21. চন্ডীদাস সম্পর্কে সর্বপ্রথম বিস্তারিত আলোচনা করেন রামগতি ন্যায়রত্ন ‘বাঙালা ভাষা ও বাঙালা সাহিত্য বিষায়ক প্রস্তাব’ গ্রন্থে ।
22. চন্ডীদাসের জীবনী লিখেছেন কৃষ্ণ প্রসাদ সেন ।

No comments